নাজমুন নাহার ঝুমুর: গেলো ৯ ডিসেম্বর ২০২৩ নারীমুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার ১৪৩ তম জন্ম ও ৯১তম মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হয়েছে । সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা, নারীর সামনে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করার সাহস, যুক্তি ও আপন প্রত্যয় নির্মাণের লক্ষ্যে আজীবন তিনি সংগ্রাম করেছেন- লিখেছেন, স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন, সংগঠন গড়ে তুলেছেন।

১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে রোকেয়া জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর তাঁর কর্মময় সংগ্রামী জীবনের অবসান ঘটে। সে সময় মেয়েদের লেখাপড়I ছিলো সামাজিক ভাবে নিষিদ্ধ ও পাপতুল্য I অশিক্ষার অভিশাপ ও পুরুষ তন্ত্রের অবরোধ প্রথার মধ্যেই তিনি বড় হন I ভাই ইব্রাহিম সাবের ও বড় বোন করিমুন্নেসা কাছ থেকে কিছু বাংলা ও ইংরেজি শিখেছিলেন। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়তো তখন রোকেয়া মোমের আলোয় পড়Iলেখা করতেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে ও ২৯ বছর বয়সে বিধবা হয়ে রোকেয়া বুঝেছিলেন সমাজে নারীর অবস্থান কতটা নিগৃহীত। এ থেকে নারীকে মুক্ত ও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমে প্রয়োজন নারীর শিক্ষা। তাই, স্বামীর মৃত্যুর পর ১৯০৯ সালে ভাগলপুরে নিজ বাড়িতে ৫ জন ছাত্রীকে নিয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু স্বামীর আত্মীয় স্বজনদের বাধায় স্কুল চালাতে পারলেন না, চলে আসেন কোলকাতায়। ১৯১১ সালে ৮ জন ছাত্রী নিয়ে কোলকাতার অলিউল্লাহ লেনে স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। কেবলমাত্র মুসলিম নারীদের শিক্ষা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা নয়, রোকেয়ার জীবন সংগ্রামের উদ্দেশো ছিলো আর অনেক বড়।

তিনি চেয়েছিলেন সমাজের অগ্রগতি । অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীকে পশ্চাতে ফেলে রেখে সমাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়। নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সারাজীবন তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁকে সমাজের নানা অংশের মানুষের কাছ থেকে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও আঘাত সহ্য করতে হয়েছে। সেই ক্ষতবিক্ষত অভিজ্ঞতা নিয়ে বেগম রোকেয়া লিখেছিলেন – ‘ঝদি সমাজের জন্য কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে, যেনো নিন্দা, গ্লানি, উপেক্ষা আপানাকে কিছুতেই আঘাত করিতে না পারে।‘
বেগম রোকেয়া সমাজে নারীর যে অবস্থান দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর ৯০ বছর পরেও আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারিনি। বাহ্যিকভাবে দেখা যাবে, নারী মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী ও হচ্ছেন। কিন্তু সমাজ মননে আর ও বেশি অবক্ষয় ঘটে গেছে। সারাদেশে নারী-শিশু ধর্ষণ-নির্যাতন-হত্যা এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দুই বছরের শিশু কন্যা বা ৬০ বছরের বৃদ্ধা যে কোনো বয়সের নারী; হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলিম ও আদিবাসী যে কোনো ধর্মের বা জাতির নারী; পাহাড়ে বা সমতলে, ঘরে-বাইরে সর্বত্র যে কোনো স্থানে; দিনে-রাতে যে কোনো সময়ে বাংলাদেশে একজন নারী নির্যাতনের শিকার হতে পারেন। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, বন্দি রেখে গণধর্ষণ যৌতুকের জন্য নির্যাতন- হত্যা, বখাটেদের উৎপীড়ণ, ইন্টারনেটে ব্লাকমাইলসহ নান উৎপীড়ণ, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন এমন মাত্রায় পৌছেছে যে, সব সময় নারীকে উৎকণ্ঠা নিয়ে চলতে হয়।

স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও বাংলাদেশের আইনেই নারীর প্রতি বৈষম্য করে রাখা হয়েছে; সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ বিবাহ-বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব অর্থাৎ পারিবারিক জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে। সমকাজে সমমজুরি আইনে থাকলেও; বাস্তবে প্রায় সমস্ত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারী পুরুষের তুলনায় কম মজুরি পেয়ে থাকেন। এখনও সরকারি হিসাব মতেই ১০০ জনে ৫২ জন নারীর বাল্যবিবাহ হয়। নারীরা দিনে প্রায় ১৬ ঘন্টায় গড়ে ৪৫ ধরণের কাজ করেন। নারীর গৃহস্থালী কাজ ছাড়া সংসার পরিবার চলেনা। কিন্তু গৃহস্থলি কাজের কোনো স্বীকৃতি পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রে নেই। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এমন এ সন্তান লালন-পালনসহ পরিবার ও ঘর-গৃহস্থালী কাজের দায়িত্ব যেন শুধুই নারীর। এলাকা ও কর্মক্ষেত্রে ডে -কেয়ার সেন্টার, গণ-পরিবহনে নারীর নিরাপত্তাহীনতা, নারীদের জন্য জেলা-উপজেলায় হোস্টেলসহ রাষ্ট্রীয় প্রায় কোনো আয়োজন না থাকায় কর্মক্ষম, শিক্ষিত অনেক নারীই কর্মক্ষেত্রে আসতে পারছেন বা কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়ছেন।

সরকারি চাকরিতে ৬ মাস সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি আর বেসরকারি চাকরিতে ৪ মাস সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটির নিয়ম বিদ্যমান রয়েছে। বাস্তবে শ্রমিক নারীরা গর্ভবতী হলে তার কপালে জোটে ছাঁটাই। এছাড়াও নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার লক্ষে রাষ্ট্রের তেমন কোন উদ্যোগ নেই। বিজ্ঞাপন, নাটক সিনেমায় নারীকে পণ্যরূপে উপস্থাপন করা হয়। পর্নোগ্রাফি ও মাদক বন্ধে সরকার মুখে জিরো টলারেন্সের কথা বললেও বাস্তবে কার্যকর উদ্যোগ নেই। মহিয়সী নারীদের জীবন ও কর্ম, বিভিন্ন গণ-আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্তকরণ বা রাষ্ট্র ও সমাজে মূল্যায়িত হয় না। ওয়াজ-মাহফিলে নারীকে নিয়ে অশ্লীল -কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেওয়া হয় । নারীর এ সকল সংকটের মুলে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিকতা ও পুঁজিবাদী শোষণমূলক ব্যবস্থা।

বর্তমান বাংলাদেশে সকল ক্ষেত্রে গণতন্ত্র সংকুচিত হচ্ছে, ধনী-গরীব বৈষম্য বেড়েই চলছে। এর প্রভাব এসে পড়েছে সমাজে-পরিবারে মানুষের মনন জগতে। সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। নারী সমাজ এই অবক্ষয় থেকে মুক্ত থাকতে পারেন না। আর যে কোনো সংকটে, সামাজিক-আর্থিক অস্থিরতার প্রথম শিকার হন নারীরা। তাই সমাজের সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, শোষণমূলক ব্যাক্তি মালিকানার সমাজ ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পরিবৰ্তনে, নারীমুক্তির আন্দোলনে বেগম রোকেয়া আজও প্রেরণার উৎস। বেগম রোকেয়ার সেই আহবান ‘জাগো গো ভগিনী। কে ধারণ করে আসুন, সমস্ত শোষণ, নির্যাতন, অন্ধত্ব, কুসংস্কার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই; নারী পুরুষের মিলিত সংগ্রামে সাম্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করি। মনুষ্যত্ব, মর্যাদা, সভ্যতা, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের দাবি আদায় করি।

নাজমুন নাহার ঝুমুর
Email : nn.jhumur01@gmail.com
কলামিস্ট ও নারী মানবাধিকার কর্মী

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email