মহিউদ্দিন তুষার: দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব, বিভিন্ন জ্বালানি উপকরণের দাম ওঠানামা, ইন্টারনেট বন্ধ এসব কারণে দেশের তৈরি পোশাকশিল্প বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। জুলাই মাসের শেষ দিকে কারফিউ জারির কারণে প্রায় এক সপ্তাহ পোশাক কারখানাগুলোতে বন্ধ থাকে উৎপাদন। পাশাপাশি বন্দর বন্ধ হয়ে পড়ায় স্থবির হয়ে পড়ে পণ্য শিপমেন্ট ও কাঁচামাল আমদানি। এ সময় অনেক বিদেশি বায়ার তাদের রফতানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন। অর্ডারগুলো চলে যেতে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য দেশে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের পর দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে শুরু করলে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের তৈরি পোশাক খাতেও। তবে এর মধ্যেই আবার নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার প্রভাব পড়ে সামগ্রিক পোশাক খাতের ওপর। বিশেষ করে বন্যায় দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আক্রান্ত হওয়ায় এর প্রভাব পড়ে শিপমেন্টসহ পণ্য পরিবহনের ওপর।

বিজিএমইএর দেয়া তথ্যমতে সব মিলিয়ে জুলাই ও আগস্ট মাসে উৎপাদন ব্যাহত হয় ১৬ দিন। উৎপাদন বন্ধ থাকা এবং পণ্য সময়মতো শিপমেন্ট করতে না পারার কারণে অনেক কারখানা মালিকই সময়মতো পেমেন্ট পাননি বলে জানিয়েছেন পোশাক রফতানিকারকরা। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক, বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের খপ্পরে পড়া ব্যাংকগুলোতে এলসি খুলতে না পারার অভিযোগ জানিয়েছেন তারা। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে দেশের পোশাক খাত ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জরুরি সহায়তা হিসেবে সহজ শর্তে প্রণোদনা সহায়তা এবং ব্যাংকের এলসি সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের প্রতি জরুরি ভিত্তিতে আহ্বান জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো।

এদিকে উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ায় কারখানা মালিকরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন তা সমাধানের ব্যাপারে বিজিএমইএ’র তরফে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানান তারা।

সংগঠনের নেতারা বলছে, নতুন যে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে, এই সরকারের প্রতি আমরা আস্থাশীল। তার আন্তর্জাতিক ইমেজ রয়েছে। তাই আমরা আশা করছি যে অর্ডারগুলো আমরা হারিয়েছি তা আমরা অচিরেই ফেরত পাব। আমরা বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেছি। আমাদের কয়েকটি দাবির কথা জানিয়েছি। বিশেষ করে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। জুলাই ও আগস্ট মাস মিলিয়ে আমাদের মোট ১৬ দিন কাজ হয়নি। এজন্য আমাদের রফতানিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এজন্য আমরা সরকারের কাছে সহজ শর্তে ঋণ চেয়েছি।

তাছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী আগস্ট মাসের বেতন যদি ঠিকভাবে না দেয়া যায় তবে শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হতে পারে। যেহেতু এমন আশঙ্কা রয়েছে, তার ওপর অনেক কারখানা মালিকেরই সক্ষমতা নেই, তারা শিপমেন্ট করতে পারেননি, অনেকের পণ্য পড়ে আছে, অনেকের পেমেন্ট আসেনি। এজন্য আমরা বারো মাসের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা চেয়েছি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে। তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। ইনশাল্লাহ রোববারের মধ্যে আমরা পেয়ে যাব।

জুলাই আগস্ট মাসে কয়েকদিন উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার জেরে সমস্যায় পড়েছেন অনেক কারখানা মালিক ও রফতানিকারক। তাদের সমস্যা সমাধানে বিজিএমইএ’র উদ্যোগ সম্পর্কে তারা বলেন, আমাদের এখন মূল লক্ষ্য শ্রমিকদের আগস্ট মাসের বেতনটা নিশ্চিত করা। যদি আমরা সময় মতো সঠিকভাবে বেতনটা দিতে পারি, তবে আস্তে আস্তে আমরা সামনের মাসগুলোতে যে ব্যাকলগগুলো তৈরি হয়েছে তা সমাধান করে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব।

এ পরিস্থিতিতে সেপ্টেম্বর মাসে সঠিক সময়ে বেতন দিতে পারাটাই আমাদের জন্য প্রথম প্রয়োরিটি। কারণ আমাদের শ্রমিকরা একটা নির্দিষ্ট সময়ে বেতন পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তারা যদি সময় মতো বেতনটা না পান তবে তাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। যা বর্তমান পরিস্থিতিতে কাম্য নয়। কারণ বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন তরফে ইন্ধন তো রয়েছেই। এর আগে কোভিডের সময় আমরা ঋণের কিস্তি দেয়ার ব্যাপারে ছয় মাসের একটা সময় পেতাম, এখন সেটা তিন মাস করা হয়েছে। এখন যেহেতু সংকটময় সময়, তাই এই পরিস্থিতি উত্তরণে আমরা সেটা আবার ছয় মাসে পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছি। পাশাপাশি আমাদের কারখানাগুলোর ইউটিলিটি বিলগুলো আমরা সময় মতোই পরিশোধ করার চেষ্টা করি। তবে যদি ক্ষেত্র বিশেষে যদি বিল বকেয়া পড়ে, তবে যেন ছয় মাস পর্যন্ত আমাদের কারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়, আমরা সেই অনুরোধ করেছি।

সব মিলিয়ে এই খাতকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি, যেন আমাদের সময় দেয়া হয়। বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকারে অধীনে দেশের পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল উল্লেখ করে তারা বলেন, আশা করি দুই এক মাসের মধ্যেই আমাদের পোশাক খাত পূর্ণ গতিতে ছুটতে শুরু করবে। আন্তর্জাতিক বাজারেও আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

অপরদিকে পোশাক খাতের অপর গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বিকেএমইএ এর নেতারা বলছে, এই মুহূর্তে আমাদের ব্যাংকে এলসি খোলা নিয়ে সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। এখন যদি আমাদের রফতানির লিড টাইমের ১৬ দিন যদি ব্যাংকেই এলসি না খুলতে পারার কারণে অপচয় হয়, তবে পরবর্তীতে শিপমেন্ট নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হবে তার দায় কে নেবে। আমরা শিপমেন্টটা কীভাবে করব। আমরা যদি শিপমেন্ট সময়ে পিছিয়ে পড়ি তাহলে আমাদের এয়ারশিপমেন্টে যেতে হবে, যেখানে খরচ অনেক বেশি। অথবা ক্রেতারা আমাদের কাছে ডিসকাউন্ট চাইবে।

এর বোঝা শেষ পর্যন্ত চাপবে রফতানিকারকদের ঘাড়ে। অথচ সমস্যা তৈরি করছে ব্যাংকগুলো। তাই দায় তাদেরই নিতে হবে। এই সমস্যাগুলো সমাধানে আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। এর আগে আন্দোলন দমনের নামে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের কারফিউ জারি ও ইন্টারনেট শাটডাউনের কারণে পোশাক কারখানার মালিক ও রফতানিকারকরা ভুক্তভোগী হয়েছেন উল্লেখ করে তারা বলেন, এখন যদি ব্যাংক ও কাস্টমস এ আমাদের ভোগান্তি না পোহাতে হয়, তবে আগামী অল্পদিনের মধ্যেই উৎপাদনের পরিবেশ পুরোদমে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

এনবিআর ও কাস্টমসের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান আবদুর রহমানের ওপর আস্থা প্রকাশ করে বিকেএমইএ সভাপতি বলেন, আমরা ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যেই এনবিআর এর চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে, তাদের আমরা আমাদের সমস্যার কথা জানিয়েছি। তিনি অত্যন্ত সজ্জন ও দক্ষ একজন মানুষ। আমাদের সমস্যাগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে শুনেছেন এবং সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। সব মিলিয়ে নতুন এই অন্তর্র্বতী সরকারের প্রতি আমাদের জ্বালানি, ব্যাংকিং এবং কাস্টমসের সমস্যা দূর করার জন্য আহ্বান জানিয়েছি।

এমটি/ এএটি

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email