* দূর্বল ব্যাংকের বেশিরভাগ ক্যাশ কাউন্টারে একই সুর টাকা নাই
* ৫ লাখ টাকার চাহিদায় দিতে রাজি ৫ হাজার
* গ্রাহকরা অভিযোগ করলেও মিরছে না সন্তোষজনক জবাব
* কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির পরেও এখন মিলেনি অর্থ ধার

মহিউদ্দিন তুষার: সিরাজুল ইসলামের মা বেশ কয়েকদিন ধরেই ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতলে ভর্তি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সোমবার বার রাতে জানান তার মাকে দুই/এক দিনের মধ্যেই অপারেশন করাতে হবে। খরচ হবে প্রায় ৫ লাখ টাকা। এই খবরটি গ্রামে থাকা সিরাজুল ইসলামের ছোট ভাই ইকবাল হোসেনকে জানিয়ে সকালে ব্যাংক থেকে টাকা তোলতে বললেন। পরের দিন সকালে ইকবাল হোসেন মায়ের অপারেশনের টাকা তোলার জন্য শরীয়তপুরের ঘড়িসার বাজার ন্যাশনাল ব্যাংক শাখায় জান। ঐ শাখার লোকজন জানান, ৫ লাখ টাকা দূরের কথা ৫ হাজার টাকা নিতে হলে ২ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। এমন খবর সিরাজুল ইসলামকে জানায় তার ছোট ভাই।

মায়ের অপারেশনের জন্য টাকা দরকার ব্যাংক থেকে টাকা তোলা যাচ্ছে না এমন সংবাদ পরিবারের কাছে পৌছালে সবাই চিন্তায় পড়ে যায়। পরে ঐ শাখার এক কর্মকর্তা পরামর্শ দেয় ঢাকার কোন বড় শাখা থেকে তোলার জন্য। মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকায় এসে ন্যাশনাল ব্যাংকের একাধিক শাখাতে গেলেও টাকা উত্তোলন করতে পারেনি ইকবাল। সব শাখা থেকে পরের দিন সকালে আসতে বলেন। তবে তাকে পরামর্শ দিয়ে জানান, কোন শাখাতেই ৫ লাখ টাকা দিবে না। ৫০ হাজার বা ১ লক্ষ টাকা করে একাধিক শাখা থেকে তোলার জন্য বলেন।

ইকবাল হোসেন বুধবার সকাল সকাল আবুল হোটেলের পাশে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকে গেলে টাকা নেই বলে ফিরিয়ে দেন। পরে সে মতিঝিলের দিলকুশা শাখাতে গেলে ৫০ হাজার টাকা দেন। এরপর মতিঝিল শাখাতে গিয়ে অনেক অনুরোধ করে আরও ৫০ হাজার টাকা তোলেন। সেখান থেকে গুলিস্তান স্টেডিয়ামের পাশে থাকা বৈদেশিক শাখাতে গেলে টাকা নাই বলে ফিরিয়ে দেন। এভাবে আরও কয়েকটি শাখা ঘুরে কোন এক ব্যক্তিকে অনুরোধ করে আরও ৫০ হাজার টাকা তোলেন। বাকি টাকা কিভাবে সংগ্রহ করবেন জানেন না ইকবাল।

সোহাগ বিশ্বাস নামে এক গ্রাহক বুধবার সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) মতিঝিল শাখায় একটি চেকে ২ লাখ টাকা তুলতে যান। ব্যাংক থেকে জানানো হয়, টাকা নেই কোনভাবেই এই টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। আলামিন নামে অপর এক গ্রাহক একটি চেকে ৭০ হাজার টাকার চেক দিলেও তিনি টাকা তুলতে পারেননি। এতো টাকা প্রদাণ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়া হয় ওই গ্রাহককে। যদিও এসআইবিএল’র একজন কর্মকর্তা জানান, কোনো কোনো ব্র্যাঞ্চ ৩০ হাজার টাকাও দিতে পারছেনা। অনেক ব্র্যাঞ্চে গ্রাহকদের সঙ্গে এ নিয়ে বাক-বিতন্ডা ও হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে। গ্রাহকরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সুশাসন ফেরাতে ব্যাংকগুলোর বোর্ডে পরিবর্তন এনেছে। নতুন বোর্ড দায়িত্ব নিয়েছে। এখনও কেন গ্রাহকের বিষয়গুলো দেখছে না। গ্রাহকদের ভোগান্তি রোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানান একাধিক গ্রাহক।

এদিকে এতোদিন এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন আরেক প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকেরও একই অবস্থা। জামাল উদ্দিন নামে একজন গ্রাহক ব্যাংকটির মতিঝিল শাখায় ১ লাখ টাকার চেক দিলেও টাকা তুলতে পারেননি। ক্যাশ কাউন্টার থেকে জানানো হয়, নগদ ১ লাখ টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে নতুন চেক দিয়ে মাত্র ২০ হাজার টাকা তুলতে সক্ষম হন তিনি। একই শাখায় টাকা তুলতে আসা অপর গ্রাহক ইশরাত জাহান ২০ হাজার টাকার চেক দিলে তাঁকে ১০ হাজার টাকা নগদ দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত অভিযোগ নম্বরে কল করলে কোনো সন্তোষজনক জবাব পাননি জামাল উদ্দিন।

গ্রাহক ভোগান্তির চরমে রয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক।

সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো তুলনামূলক ভালো ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করতে পারবে, যাদের গ্যারান্টি দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো কি পরিমাণ তারল্য সহায়তা নিতে পারবে তা-ও ঠিক করে দেবে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। প্রাথমিকভাবে সমস্যায় থাকা এমন পাঁচটি ব্যাংকের সঙ্গে ঋণ গ্যারান্টি চুক্তি সই করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে নির্ধারিত মেয়াদে বিশেষ ধার পাবে। এর মধ্যে গত রোববার চার ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে আর গত বৃহস্পতিবার চুক্তি করেছিল ন্যাশনাল ব্যাংকের সঙ্গে। যদিও এখন পর্যন্ত বিশেষ ধার চেয়ে আট ব্যাংক চিঠি দিয়েছে বলে জানা গেছে।

ন্যাশনাল ব্যাংক বৈদেশিক শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহাবুর রহমান বলেন, গ্রাহকরা টাকা তোলতে আসলে দিতে পারছি না এটা খুবই দুঃখজনক। আমানতকারীরা তাদের জমানো টাকা উত্তোলন করতে আসলে সম্মানের সাথে দিব এটাই তো ব্যাংকের নিয়ম। কিন্তু কিছু দিন ধরে সমস্যার কারনে তা হচ্ছে না। তিনি বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক দায়িত্ব নিয়েছে, আশা করি আগামী সপ্তাহের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, যেসব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, তারা এখন আন্তঃব্যাংক বাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করে বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে গ্যারান্টির জন্য পাঠাবে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্যারান্টির আওতায় কোন ব্যাংক কত টাকা নিতে পারবে তা বিবেচনা করে অনুমতি দেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যেসব ব্যাংক থেকে টাকা তোলা হচ্ছে, তারা তারল্য সংকটে পড়ছে। আবার যাদের কাছে রাখা হচ্ছে তাদের তারল্য বেড়ে যাচ্ছে। এ জন্য আমরা গ্যারান্টার হয়ে তারল্য বেশি থাকা ব্যাংকগুলো থেকে কম থাকা ব্যাংকগুলোকে টাকা দেব। এক্ষেত্রে দুর্বল ব্যাংক টাকা না দিতে পারলে ওই টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক পরিশোধ করবে। এখন পর্যন্ত এই স্কিম থেকে কাউকেই টাকা দেওয়া হয়নি। যদি এদের অবস্থা ভালো হয়ে যায়, তাহলে কাউকে দিতেও হবে না। প্রয়োজন বোধে দেব। যার যত টাকা দরকার সেই অনুযায়ী টাকা দেওয়া হবে। তবে, এসব ব্যাংকে এখন ক্যাশ-ফ্লো ভালো রয়েছে। গত কয়েকদিনে ব্যাংকগুলোর তারল্য উদ্বৃত্ত আছে ৮১০ কোটি টাকা। আশা করি সমস্যা সমাধান হবে।

এমটি/ এএটি

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email