আওয়ামী লীগের হালচাল
কেন্দ্রের সাথে তৃণমূলের যোগাযোগ নাই
হামলা-মামলার আতঙ্কে দিন কাটছে তৃণমূলে
বিপদে ফোন দিলেও কেউ না ধরা অভিযোগ
তৃণমূলের অনেকেই রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন
বাঁচলে রাজনীতি করা যাবে- কেন্দ্রীয় এক নেতা

মহিউদ্দিন তুষার
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দেশ ত্যাগের পর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যার সহযোগী মন্ত্রী-এমপি,ব্যবসায়ীসহ আওয়ামী লীগ নেতারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকেই দেশ ছাড়েন। যারা দেশ ছাড়তে পারেননি তাদের মধ্যে কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছেন বাকিরা রয়েছেন আত্মগোপনে। শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগ, কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতার ও আত্মগোপনে থাকার কারনে গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে চরম নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দিয়েছে। সাংগঠনিকভাবে দলটির রীতিমত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তৃণমূলের অনেকেই উদ্বেগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ দল এবং একেবারে রাজনীতি ছাড়ার কথাও ভাবছেন। স্বাধীনতার পরে কোন রাজনৈতিক দলের এমন করুণ অবস্থা দেখেনি। আওয়ামীলীগের মত এত বড় দলকে কেন এভাবে পালাতে হবে প্রশ্ন তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের।

১৪ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন পর্যন্ত ২৩ দিনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় ৪৫ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপি। তাদের মধ্যে শেখ হাসিনার পতনের দিন দেশ ছাড়েন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ সব ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্টে একাধিক তালিকা পাঠানো হয়। এই তালিকায় হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয়, মহানগর ও জেলা কমিটির নেতাদের নামও রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, জাতীয় সংসদের সব এমপি এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা দলবাজ কর্মকর্তাদের নামে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার তালিকা দেওয়ার পর আর কেউ আকাশ পথে পালাতে পারেনি। তবে আত্মগোপনে থাকা অনেকেই পাশের দেশ ভারতে পালিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত ও শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে সেটি হচ্ছে– দলটির অন্যান্য প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অনুগত পুলিশ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা কোথায় আছেন? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলার সময় আওয়ামী লীগ সরকারের যে দুজনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন তারা হলেন তৎকালীন সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তারা দুজনই দেশ ত্যাগ করেছেন বলে শোনা যায়।

আওয়ামী লীগ সরকারে যারা প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তাদের মধ্যে সালমান এফ রহমান এবং আনিসুল হক, শাজাহান খান, টিপু মুন্সী, আব্দুল মান্নান, সাবের হোসেন চৌধুরী, আসাদুজ্জামান নূর, দিপু মনি, জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাধন চন্দ্র মজুমদার এবং সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতাকৃতদের মধ্যে আবার কেউ কেউ জামিনে ছাড়াও পেয়েছেন।
কারাসূত্র বলেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গণহত্যায় জড়িতসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৩ অক্টোবর দুপুর পর্যন্ত ৮০ জন ভিআইপি মর্যাদার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই তালিকায় আছেন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, শিল্পপতি, পুলিশের আইজি, সাবেক ডিএমপি কমিশনার, সম্প্রতি দায়িত্ব পালনকারী কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে ভিআইপি বন্দির সংখ্যা ছিল ৭৬ জন। তাদের মধ্যে ডিভিশন পেয়েছেন ৪৩ জন। হাসপাতালে আছেন ৯ জন।

প্রবল গণ আন্দোলনে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে চলে যাওয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের উদ্যোগ, সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের রিমান্ডে নেওয়া, আদালতে আইনজীবী পর্যন্ত নিয়োগ করতে না পারা, এমন সব ঘটনা এখন ঘটছে। টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে ৩৬ দিনের এক আন্দোলনে পতন ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের। সব মিলিয়ে বিপর্যয়ে পড়ে গেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা দলটি। প্রথমবারের মত আন্দোলন মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়া দলটির আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ নেতারা তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে কোন যোগাযোগ নাই বলে অভিযোগ করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

নেতা-সমর্থকরা বলেন, দ্ইুমাস হয়ে গেলো অথচ কেন্দ্র থেকে কার্যকর কোনো নির্দেশনা দেওয়া হলো না। ফোন দিলেও কেউ ধরে না। এদিকে হামলা-মামলা সব মিলিয়ে হতাশার মধ্যে আছি আমরা। বর্তমানে আওয়ামীলীগের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নেতাকর্মীদের অনেকে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন। আওয়ামী লীগের এখনকার যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, সেটার জন্য দলের সিনিয়র নেতাদের দায়ী করছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা।

তারা অভিযোগ করে বলেন, ক্ষমতা হারালে এমন অবস্থা যে হতে পারে, সেটা তো নেতাদের অজানা থাকার কথা না। তারাই তো এর জন্য দায়ী, বলছিলেন শরীয়তপুরের একজন আওয়ামী লীগ কর্মী। এলাকা ছেড়ে দুইমাস আগে তিনি ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা বলেন, ক্রিম খাইলো নেতারা, কোটি কোটি টাকা বানাইলো তারা; আর তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হইতেছে আমাদের মতো তৃণমূলের নেতাকর্মীদের।

পতিত শেখ হাসিনা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য কাউকে কাউকে ভারতের বিভিন্ন মাজার ও পার্কেও দেখা গেছে। হত্যা মামলার পরেও এসব আসামি কিভাবে পালালেন, কারা তাদের পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে, এসব বিষয়ে জনমনে যথেষ্ট প্রশ্ন ও উদ্বেগ রয়েছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগের যেসব নেতা দেশ ছেড়ে গেছেন বলে বলা হচ্ছে, সেটি ‘সমঝোতার মাধ্যমে’ হতে পারে। সমঝোতার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে সেইফ এক্সিট দেওয়া হয়েছে। বিষয়টা আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে বলে ধারণা করা যায়।

আওয়ামীলীগের এক শীর্ষ নেতা বলেন, অনেক লোক দলে উড়ে এসে জুড়ে বসার কারণে এমনটা হয়েছে। দলের পরিস্থিতি খারাপ দেখলেই তারা লুকিয়ে থাকেন। তারা আসেন রাজনীতিকে ব্যবহার করে টাকা কামাতে, কখনই দলকে ভালোবেসে আসে না। এই ভুল থেকে সব রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষা নেওয়া উচিত বলেও জানান তিনি।

দল থেকে তৃণমূলে কনে কোন ধরনের দির্দেশনা দেওয়া হয়না জানতে চাইলে যুব লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই নির্দেশনা দেওয়া হবে। তৃণমূল থেকে কেউ ফোন দিলে কেন ধরে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যক্তি নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে হয়তো বিষয়গুলো এড়িয়ে যায়। দেখা যাচ্ছে প্রায় সবার নামেই মামলা হয়েছে। লোকেশন না জানানো একটা ব্যাপার থাকতে পারে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email