আগে সংস্কার পরে নির্বাচন: জামায়াত
সংস্কারের আগে নির্বাচন নয়: গণফোরাম
গণতান্ত্রিক রূপান্তর ছাড়া ভালো নির্বাচন সম্ভব না: গণসংহতি আন্দোলন
নির্বাচনের জন্য এক বছর যথেষ্ট সময়: গণঅধকিার পরষিদ
আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব হতে পারে: আসিফ নজরুল

মহিউদ্দিন তুষার: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে রাজনৈতিক দলসহ নানা মহলে আলোচনা শুরু হয়। এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা না পাওয়ায় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে। তবে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সম্প্রতি দেওয়া বক্তব্যে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে দলগুলো। নির্বাচন নিয়ে তাদের বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন। তবে নির্বাচন, সংস্কার ও সময় নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে একটি রোডম্যাপ চান দলগুলোর নীতিনির্ধারকরা। আবার কেউ কেউ নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

তাড়াতাড়ি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্ছার বিএনপি। এ জন্য দ্রুত সংস্কার চায় দলটি। নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় ক’টি প্রস্তাব বাস্তবায়ন করে বাকিগুলো পরে সংসদে আলোচনা করে চূড়ান্ত করতে চায় তারা। এ জন্যই অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কারের জন্য বেশি সময় না নিয়ে অবিলম্বে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি করে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অবিলম্বে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়ে সুযোগ তৈরি করেছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার, আমাদের ব্যবস্থাকে জনগণ যেভাবে চায়, সেভাবে নিয়ে আসার। সেটা কি নস্যাৎ করার জন্য ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে? যাঁরা দায়িত্ব পেয়েছেন, এই সরকার যাঁদের দায়িত্ব দিয়েছে, তাঁদের মধ্য থেকে যখন বলেন নতুন দল তৈরি করতে হবে, তখন বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। যদি বলেন নতুন দল তৈরি করতে হবে, তাহলে জনগণ কী করে বুঝবে যে তাঁরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করছেন?’

তিনি বলেন, আমরা মনে করি, নির্বাচন যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই হওয়া উচিত। নির্বাচন যত দ্রুত হবে, ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে। যত দেরি হবে, তত দেশের ক্ষতি হবে, তত সমাজের ক্ষতি হবে, রাজনীতির ক্ষতি হবে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। সেজন্যই নির্বাচনের দরকার।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। নির্বাচন কমিশনে যতটুকু স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়া দরকার, সেসব প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে তুলে দেন।

নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা, পররাষ্ট্র, সংসদ, চাকরি, শিক্ষা এবং বিনোদনসহ অন্তর্বর্তী সরকারকে ১০টি খাতে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাবনা দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে যে, নির্বাচনী রোডম্যাপ দিতে হবে। আমরা বলছি-একটা রোডম্যাপে হবে না। দুইটা রোডম্যাপ দিতে হবে। প্রথম রোডম্যাপটি হবে সংস্কারের। কি কি বিষয়ে সংস্কারের কাজ উনারা করবেন এবং তার সময়সীমা কি হবে। এটা যখন একটা পূর্ণতার পর্যায়ে পৌছে যাবে, সঙ্গে-সঙ্গেই একটা নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়ে দিতে হবে, আর দেরি করা যাবে না। তিনি বলেন, প্রথম রোডম্যাপ সফল হলে দ্বিতীয় রোডম্যাপটাও সফল হবে। প্রথমটা সফল না হলে দ্বিতীয়টার কোনো প্রয়োজনই নাই। আর এটা সফল করতে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বসে ঐকমত্যে আসতে হবে। জামায়াতের আমির বলেন, আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা রাখার পক্ষে। আমরা দেখতে চাই তারা সফল হবেন। তারা সফল হলে বিপ্লব সফল হবে। তারা ভুল করলে, বিপ্লব ব্যর্থ হলে দায় তাদের ওপর অবশ্যই বর্তাবে। তারা ব্যর্থ হোক, আমরা এটা চাই না। এজন্য জনগণের পক্ষ থেকে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে চাই। শুধু বলব-বিপ্লবের চেতনা ধরে আপনারা চলেন।

গণফোরামের একাংশের সভাপতি মোস্তফা মহসিন মন্টু জানান, ক্ষমতায় গেলে আমরা সবাই রাবণ হয়ে যাই। তাই নির্বাচনের আগে সংস্কার দরকার। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন করলে ভালো কিছু আসবে না। আমাদের দাবি সংস্কারের আগে নির্বাচন নয়। সংস্কারের জন্য যতটা সময় দরকার আমরা দিব। তিনি বলেন, পতিত স্বৈরাচার ও তাদের বিদেশি এজেন্টরা বাংলাদেশকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এ থেকে উদ্ধারের জন্য আমাদের সবাইকে জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক রূপান্তর ছাড়া ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়। জুলাই-আগস্টের বিপ্লবকে সফল করতে হলে সব ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে। এটাই দেশের জনগণ চায়। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রয়োজন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সুষ্ঠু নির্বাচন করার আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। দলগুলো যখন চায় আমি ম্যানিপুলেট করব, তাহলে তা করা যায়। প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার। কবে নির্বাচন এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব প্রথমে সংস্কার করতে হবে। সংস্কারের পরই নির্বাচনের পক্ষে তিনি।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো কেউ কেউ ৬ মাস, কেউ ১ বছরের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছে। এটা আসলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সময়টা নির্বাচন করা উচিত। আমি মনে করি, এক বছরের মধ্যেই চাইলে নির্বাচন সম্ভব, এক বছর যথেষ্ট সময়। কারণ, গণতান্ত্রিক সরকার না থাকলে দেশে বিনিয়োগ আসবে না। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হবে। সেক্ষেত্রে সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। সেক্ষেত্রে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যদি একটা অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘদিন থাকে।

আইন বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, নির্বাচনের জন্য সংস্কার ও রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন। সার্চ কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন এসব ঠিক থাকলে নির্বাচন হয়তো হতে পারে আগামী বছর।

সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধানও নির্বাচন কবে হতে পারে, সে বিষয়ে আভাস দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সংস্কারের মধ্য দিয়ে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে উত্তরণ’ ঘটা উচিত। তবে সেজন্য সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email