কোনো কোনো ব্যাংকে তদবিরে মিলছে টাকা
জমানো বেশি টাকা তুলতে দিতে হয় ঘুম
দু-একটি ব্যাংক দিতে পারছে না দুই হাজার টাকাও
আমানতের ১৬ লাখে মাসে পায় ২ লাখ

মহিউদ্দিন তুষার: জসিম উদ্দিন ১৭ বছর ধরে প্রবাসে আছেন। বছরে একবার গ্রামে আসেন বাবা-মা,স্ত্রী-সন্তানদের সাথে ঈদ করতে। সংসারের খরচ বাদে বাকি সব টাকা রেখেছেন ঘড়িসার বাজার ন্যাশনাল ব্যাংক শাখায়। দুই মাস ধরে তার প্রয়োজনীয় অর্থ উত্তোলন করতে পারছে না জমা রাখা একশ ভাগের দুই ভাগ টাকাও। মতিঝিলে ইউনিয়ন ব্যাংকে ৭ দিন ঘুরে এক গ্রাহক তুলতে পারেন ১৫ হাজার টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের রিং রোড ব্রাঞ্চে বেতনের টাকা তুলতে যান মার্জিয়া প্রভা। কিন্তু ব্রাঞ্চের ডেস্ক থেকে তাকে জানানো হয় একদিনে পাঁচ হাজারের বেশি টাকা তোলা যাবে না। একই ব্যাংকে ১৬ লাখ টাকার একটি এফডিআর করা ছিল রাসিদার। নিজস্ব প্রয়োজনে গুলশান ব্রাঞ্চ থেকে এফডিআর ভেঙ্গে ১০ লাখের মতো টাকা অন্য একটি অ্যাকাউন্টে পাঠানোর আবেদন করলে ব্যাংক থেকে তাকে একটি পে-অর্ডার দেয়া হয়। কিন্তু পরপর তিনবার সেই পে-অর্ডারটি বাউন্স করে।

ভুক্তভোগী জানান, ১ মাসে ২ লাখ টাকা তুলতে পারেন। দু-একটি ব্যাংক গ্রাহককে জমানো টাকা যাই থাকুক না কেন, দুই হাজার টাকাও দিতে পারছে না। টাকা না পাওয়ায় দৈনন্দিন কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে গ্রাহকদের। চিকিৎসা ব্যয়, স্কুলের বেতন-ভাতা, সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি প্রদান নিয়েও অনেক গ্রাহক বিপাকে আছেন। কোনো কোনো ব্যাংকে তদবিরে মিলছে নগদ পাঁচ হাজার টাকা। তাও এক দিন মিললে এক সপ্তাহের মধ্যে আর মিলছে না। পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়েছে যে, ব্যাংক কর্মকর্তারা ব্যাংকে আসতে ভয় পাচ্ছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির আওতায় ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা পেয়েছে। তা সত্ত্বেও আমানতকারীরা তাদের প্রয়োজনীয় অর্থ উত্তোলন করতে পারছেন না।

বাবা-মায়ের চিকিৎসাসহ সংসারের খরচের জন্য বিদেশ থেকে গত ২৪ অক্টোবর এক লাখ টাকা পাঠান রইসউদ্দিন। সেই টাকা তোলার জন্য সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) নারায়ণগঞ্জ শাখা থেকে ১০ দিন ঘুরেও সব টাকা উত্তোলন করতে পারেনি। মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে সাদেকুর বলেন, সংসারের খরচ মেটাতে কমপক্ষে ৭০ হাজার টাকা তুলতে হবে। কিন্তু এসআইবিএল নগদ অর্থের তীব্র সংকটে থাকায় ব্যাংক কর্মকর্তারা কয়েক কিস্তিতে টাকা নেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এমন অভিজ্ঞতা শুধু সাদেকুরের নয়, এস আলম গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত সংকটাপন্ন ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণে তাদের অনেক গ্রাহক জমা অর্থ তুলতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঋণগ্রহীতারা আত্মগোপনে চলে গেছেন এবং তহবিলের অব্যবস্থাপনার কারণে তাদের ব্যবসা ‘দুর্বল’ হয়ে পড়েছে।
এসআইবিএলের নারায়ণগঞ্জ শাখার এক কর্মকর্তা জানান, অনেক আমানতকারী তাদের পুরো ব্যালেন্স তুলে নিতে চাচ্ছেন। এ কারণে ব্যাপক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে এই ব্যাংক। যদি এক-তৃতীয়াংশ আমানতকারীও স্বল্প সময়ের নোটিশে তাদের পুরো অর্থ উত্তোলনের চেষ্টা করেন, তবে তা যেকোনো ব্যাংকের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী জমা করা অর্থ দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন ঋণে বিনিয়োগ করা হয়। তিনি জানান, তারা আমানতকারীদের অল্প পরিমাণে নগদ অর্থ সরবরাহ করছেন এবং তাদের অর্থ কিস্তিতে ফেরতের আশ্বাস দিয়েছেন।

সম্প্রতি নগদ অর্থের প্রচলন কমলেও ঋণের কিস্তি নিয়মিত করে তা পুনরুদ্ধার করতে কাজ করছে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির আওতায় ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (এফএসআইবি), গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার আন্তঃব্যাংক তারল্য সহায়তা পেয়েছে। তা সত্ত্বেও আমানতকারীরা এসব ব্যাংকের শাখা, প্রধান কার্যালয় ও এটিএম বুথে ভিড় জমাচ্ছেন। কিন্তু অনেক সময় তারা প্রয়োজনীয় অর্থ উত্তোলন করতে পারছেন না।

ন্যাশনাল ব্যাংক ছাড়াও তারল্য সংকটে থাকা অন্য ব্যাংকগুলোর পর্ষদে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণকারী অংশীদারত্ব রয়েছে। ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এস আলম গ্রুপ নিয়েছে এবং এসব অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ফলে ঋণগুলো খেলাপি হয়ে যায়। এতে করে এস আলম গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকের চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণ নগদ অর্থের ঘাটতি রয়েছে।

এসআইবিএলের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ ফোরকানুল্লাহ বলেন, নগদ অর্থের চাহিদা মেটাতে তাৎক্ষণিক তারল্য সমাধানের ব্যবস্থা করতে ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতা নিচ্ছে। ব্যাংকটি গত দুই মাসে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ঋণের কিস্তি ও আমানত সংগ্রহ করেছে। এটি এসআইবিএলের নগদ প্রবাহকে ত্বরান্বিত করেছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসআইবিএল বর্তমানে আমানতকারীদের প্রয়োজন অনুযায়ী নগদ চাহিদা পূরণ করছে। কিন্তু একাধিক গ্রাহক একসঙ্গে টাকা তোলার চেষ্টা করায় কিছু শাখায় সমস্যা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এই সমস্যা সম্পর্কে সবাই সচেতন। তবে গ্রাহকরা যদি তাদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের বাইরে নগদ উত্তোলন অব্যাহত রাখেন তবে এটি দীর্ঘায়িত হবে। স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরলে আমানতকারীরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা পাবেন ব্যাংক থেকে।

এফএসআইবির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে তারল্য সহায়তার পর স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম পুনরায় চালু হয়েছে। বোর্ড পুনর্গঠনের পর থেকে ব্যাংকটি সফলভাবে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে যথেষ্ট তহবিল পুনরুদ্ধার করেছে বলে জানান তিনি।

আবদুল মান্নান বলেন, এফএসআইবি গ্রাহকদের মৌলিক চাহিদা, জরুরি চিকিৎসা, জরুরি পরিস্থিতি এবং রেমিট্যান্স এনক্যাশমেন্ট পূরণের জন্য ঋণ পরিশোধকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। পর্যায়ক্রমে বড় আমানতকারীদের ঋণ পরিশোধেও কাজ করছে ব্যাংকটি।

ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, গ্রাহকদের অর্থ দিচ্ছে ব্যাংক। যদিও বড় অংকের উত্তোলন প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে সম্পন্ন করা হবে। তিনি বলেন, এসব সমস্যা রাতারাতি তৈরি হয়নি; বেশ কয়েক বছর ধরে তৈরি হয়েছে। আমানতকারীদের ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানাচ্ছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকের অবস্থার উন্নতি হবে।

এমটি/ এএটি