ইয়াহিয়া নয়ন: সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া কোনো দেশের উন্নয়ন গতিশীল হতে পারে না; দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সাংবিধানিক ধারায় দেশে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। গোটা দেশ নির্বাচনী উৎসবে মেতেছে। কিন্তু তার মধ্যেই জনমনে একটা ভীতি বিরাজ করছে। নিবন্ধিত ৪৪ দলের মধ্যে ৩০ দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বাকি দলগুলো নির্বাচন প্রতিহত-প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে।

সারাদেশে এখন একটা চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। বিপর্যস্ত মানুষ এখন জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। রাস্তায় বের হলে নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারবে তো? সেই প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে সবার মনে। পরিবারের কেউ ঘরের বাইরে গেলে সে ফিরে না আসা পর্যন্ত বাড়ির সবাই টেনশনে থাকে। মানুষ ভাবছে বিএনপি-জামায়াতের অব্যাহত হরতাল-অবরোধে গণপরিবহনে ওঠা কি জীবনের ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে? বিত্তবানরা ভাবছে গাড়িতে চড়ে কর্মস্থল বা গন্তব্যে যাওয়া কি ঠিক হবে? তাদের গাড়িটা, এমনকি তারা নিজেরাও কি অক্ষত অবস্থায় ঘরে ফিরতে পারবেন?

সরকারি সংস্থা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপির সরকার পতনের সমাবেশকে ঘিরে সংঘর্ষের পর থেকে ২৪ দিনে সারাদেশে ১৮৫টি যানবাহন ও ১৫টি স্থাপনায় আগুন দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ সংখ্যা কম নয়। মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে আন্দোলনের নামে।

জনগণকে শাস্তি দিয়ে, রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে তারা আসলে আগের মতোই নিজেদের এই রাষ্ট্রেরবিরোধী শক্তি হিসেবে প্রমাণ করে চলেছে। যে দলই বিরোধী দলে থাকুক, তাদের হরতাল-অবরোধের বিকল্প কিছু ভাবতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আর কোনো জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ চায় না সাধারণ মানুষ।

টেলিভিশনে বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, আন্দোলনের কারণে পরিবহন খাতে গত প্রায় এক মাসে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১২শ কোটি টাকা বলে ধারণা করছে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। আর অর্থনীতিবিদদের হিসাব মতে, চলতি হরতাল-অবরোধে দেশের অর্থনীতিতে ক্ষতি ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ ক্ষতি কি সহজে পোষানো সম্ভব?

এখন অবরোধের কারণে গ্রামাঞ্চল থেকে সবজি বা ভোগ্যপণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান কম আসছে বলে রাজধানীসহ বড় সব নগরীতে ভোগ্যপণ্যের দাম আরও বেড়ে গেছে। এতে নিষ্পেষিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রতিদিনের মতো নগর সার্ভিস বা দূরপাল্লার গাড়ি যদি সড়কে নামতে না পারে, তাতে এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে হাজার হাজার পরিবহন শ্রমিক ও কর্মচারীর সংসার কীভাবে চলবে? তারা কার কাছ থেকে পাবে ক্ষতিপূরণ?

পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরও জানান, শুধু যাত্রীবাহী বাসেই ভাঙচুর, আগুন দেওয়া হচ্ছে না, পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যানও ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হচ্ছে এখন। অন্যদিকে বাস-ট্রাকের পাশাপাশি এখন ট্রেনেও দেওয়া হচ্ছে আগুন। জামালপুরের সরিষাবাড়ী রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি আন্তঃনগর ট্রেনে দুর্বৃত্তরা দুটি বগিতে আগুন দেয়।

এর আগে টাঙ্গাইলে স্টেশনে দাঁড়ানো একটি কমিউটার ট্রেনের তিনটি বগি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সিলেট ও ঈশ্বরদীতেও স্টেশনে থেমে থাকা ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সরকার এ আগুন সন্ত্রাসের জন্য বিএনপি-জামায়াতকেই দায়ী করছে। আর বিএনপি বলছে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের লোকজন পরিবহনে আগুন দিচ্ছে। অথচ এসব কর্মকাণ্ডে যারা হাতেনাতে ধরা পড়ছে তারা সবাই বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদল-যুবদলের কর্মী।

সাধারণ মানুষের প্রশ্ন হলো- এই যে অব্যাহত হরতাল-অবরোধ, এতে আসলে কী পাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত? জনগণ কি তাদের সঙ্গে একাত্ম? এ প্রশ্নের জবাব তাদের জানতে হবে। সাধারণ মানুষ মনে করে দেশে এমন কিছু ঘটেনি যে, সারাদেশ অচল করে দিতে হবে, যাতে সরকার পালিয়ে যায়। তাই অবশ্যই হরতাল-অবরোধের মতো আন্দোলনের ফর্মুলা ত্যাগ করে নতুন কিছু ভাবতে হবে। আন্দোলন যদি করতেই হয় তা হলে সেটা সরাসরি সরকারবিরোধী হওয়া উচিত ছিল। তারা কি পারতো না পার্লামেন্ট ভবনের সামনে, সচিবালয়ের সামনে, গণভবন-রাষ্ট্রভবনের সামনে আন্দোলন করতে? তাদের হয়তো সেই সাহসই নেই।

আন্দোলনের নামে হরতাল-অবরোধের মতো সাধারণ মানুষকে দিনের পর দিন জিম্মি করে, পর্যুদস্ত করে কী পেল বিএনপি-জামায়াত? হয়তো কয়েক দশক আগেও হরতাল-অবরোধের একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল। এখন মানুষের জীবন অনেক বেশি যান্ত্রিক, অনেক বেশি অর্থসংশ্লিষ্ট। প্রতিদিন একজন অটোরিকশাওয়ালা, একটি বাস বা ট্রাক রাস্তায় না নামলে সেসব চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের সংসার অচল হয়ে যায়। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন সর্বস্তরের ব্যবসায়ীরা।

প্রতিদিন মাল-সরঞ্জাম সরবরাহ না হলে সেসব ব্যবসায়ীর অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। তাই ব্যবসায়ী, পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা কখনই হরতাল-অবরোধের পক্ষ নেন না, তারা এর বিরোধিতা করেন। সেই সত্যটাও বুঝতে হবে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমন লাগাতার হরতাল-অবরোধ চলছে কি না বলুন তো। অনেক দেশেই সরকারবিরোধী আন্দোলন হয়, রাস্তায়ও নেমে আসে বিরোধী দলসহ সাধারণ মানুষ। তবে তা অল্প কয়েকদিনের জন্য। এর পর যার যার কাজে ছুটে যায় সবাই। নইলে তার পরিবার যেমন চলবে না, তেমনি দেশের অর্থনীতিও ধ্বংস হয়ে যাবে, সেই উপলব্ধি আছে সভ্য জাতিগুলোর। নেই কেবল আমাদের দেশের বিরোধী দলের।

জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। নিবন্ধিত ৪৪টা দলের মধ্যে ৩০টা দল এতে অংশগ্রহণ করছে। এখন মানুষ মনে করছে, এ অবস্থায় বিএনপিকেও নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল। জনগণকে শাস্তি দিয়ে, রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে তারা আসলে আগের মতোই নিজেদের এ রাষ্ট্রের বিরোধী শক্তি হিসেবে প্রমাণ করে চলেছে। যে দলই বিরোধী দলে থাকুক, তাদের হরতাল-অবরোধের বিকল্প কিছু ভাবতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আর কোনো জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ চায় না সাধারণ মানুষ।

লেখক: সাংবাদিক

 

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email