* নৌকায় ভোট না দিলে এলাকা ছাড়ার হুমকি* প্রচারণায় বাধার অভিযোগে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংবাদ সম্মেলন *নিরপেক্ষ ভোট নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে* নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান জাপা প্রার্থী*নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হয়ে এখন নৌকারই বিপক্ষে * ডিসি-এসপিকে হুমকি, লক্ষ্মীপুরের পবনের প্রার্থিতা বাতিল* নাশকতাকারীদের তথ্য দিলে লাখ টাকা পুরস্কার: আইজিপি* কোনোভাবেই এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেওয়া যাবে না: ইসি
বিশেষ প্রতিবেদক
ত্রিশ উর্ধ্ব বয়সী সাব্বির আহমেদ ভোটার হওয়ার পর এখনো ভোট দিতে পারেননি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তার আসনের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ায় তাকে ভোটই দিতে হয়নি। ২০১৮ নির্বাচনে কেন্দ্রে গেলেও ভোট দেওয়ার ভাগ্য হয়নি সাব্বিরের। তার ভোট অন্য কেউ দিয়েছেন। এবার ভোট দেবেন কিনা সেটি নিয়েও অনিশ্চয়তা। তবে আরেক ভোটার মো: হানিফ মিয়া মনে করেন এবার তাদের এলাকায় ভালো ভোট হবে। নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিতে পারবেন এমন আশাও তার। বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও নতুন ভোটার নাজমা খানম ভোট দিতে আগ্রহী। তবে ভোটের পরিবেশ কেমন হবে সেটি নিয়ে ভাবনা রয়েছে তার। ভোট আসছে ভোট দিব। নতুন ভোটার হিসেবে আমরা সুষ্ঠুভাবে একটা সুন্দর নির্বাচন দেখতে চাই বলে জানান তিনি। সুমাইয়া আক্তার প্রথম ভোটার হিসেবে একটি শান্তিপূর্ণ ভোট দেখতে চান। ষাটোর্ধ বসয়ী আকবর হোসেন বলেন, আমি যখন ভোট দিতে যাব ওখানে যেন দলীয় রাজত্ব না চলে। আমি যেন নিরাপদভাবে কোনো ভয়টয় ছাড়া ভোটটা দিতে পারি এটাই হচ্ছে আমার সবচে বড় চাওয়া।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। নির্বাচনকে ঘিরে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা জমে উঠলেও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রচারশিবির ও মিছিলে হামলা, কর্মীদের মারধর, হুমকি ও সংঘাত এবং আচরণবিধি লঙ্ঘন থামছেই না। গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা শুরুর প্রথমদিন থেকে এখন পর্যন্ত যে সকল আসনে নৌকা-স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে প্রায় সব আসনেই সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এতে একাধিক খুনসহ আহত হয়েছেন প্রায় কয়েকশতাধিক। এসব সংঘাতে জড়াচ্ছেন মূলত ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নৌকার প্রার্থীর সমার্থকদের দ্বারা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থক ও নির্বাচনী প্রচারশিবিরে হামলার ঘটনা বেশি ঘটেছে।

নৌকায় ভোট না দিলে হাত কেটে নেওয়াসহ গুলি করার হুমকি দিয়েছেন মানিকগঞ্জ-২ আসন সিংগাইর উপজেলা আ.লীগের সহ-সভাপতি আলী ইস্কান্দার। এসংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফরিদ ভূঁইয়া মাসুম রাজনৈতিক বক্তব্যে নৌকা প্রতীকে ভোট না দিলে ভোটারদের বাড়ির পানি-বিদ্যুৎ ও গ্যাস বন্ধের হুমকি দেন। নৌকা প্রতীকে ভোট না দিলে এলাকা ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম। ঠাকুরগাঁও পৌরসভায় নির্বাচনী প্রচারণায় প্রকাশ্যে এ হুমকি দেন এই নেত্রী। বিভিন্ন জেলায় রাজনীতিক ব্যক্তিদের এমন বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। ভোটারদের মাঝে ছড়াচ্ছে আতঙ্ক।

প্রচারণায় বাধা, ভয়ভীতি, হুমকি-ধামকিসহ নানা ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন রাজবাড়ী-২ সংসদীয় আসনের ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী হক। প্রার্থী হবার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। প্রথমে প্রার্থীতা বাতিল করা হলেও পরবর্তীতে আপিলে প্রার্থীতা ফিরে পেয়েছেন। এ সময় তার ১০ দিন নষ্ট হয়েছে। পরবর্তীতে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে তার প্রচার-প্রচারনায় বাঁধা, পোস্টার ছেড়া, হুমকি-ধামকি দিয়ে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে ষড়যন্ত্র করা হয় বলে জানান তিনি।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোট নিরপেরতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে দিনাজপুর-২ (বিরল-বোচাগঞ্জ) আসনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান জাতীয় পার্টির (জাপা) মনোনীত প্রার্থী মাহবুব আলম। গত মঙ্গলবার দিনাজপুর বিরল উপজেলা শাখা জাতীয় পার্টির দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা দেন মাহবুব আলম। সব ধরনের কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি ঘোষণা দিয়েছেন লাঙ্গল মার্কার এই প্রার্থী।

দেশের বিভিন্ন জেলায় নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়ে এখন নৌকার বিরোধিতা করছেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানরা। নৌকার বিরোধিতা শুধু নয়, প্রকাশ্যে ঈগল প্রতীকের পক্ষে ভোট প্রার্থনার পাশাপাশি নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রচারণাও চালাচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে তারা বলছেন, আমরা নৌকা নিয়ে পাস করছি ঠিক আছে, কিন্তু আমরা নৌকার বিপক্ষে কোনো কথা বলি না। আমরা ব্যক্তির বিপক্ষে। আমরা নৌকার বিপক্ষে না। প্রধানমন্ত্রী আমাদের অপশন দিয়ে দিয়েছেন। আরও যোগ্য নেতারা আছেন, তারা যদি নির্বাচন করতে চাইতো করতে পারবেন। যারা যে পক্ষ নেবে কোনো বাধা-নিষেধ নেই। আমরা নেত্রীর নির্দেশনা মানি। আমাদের প্রতিপক্ষ বলে, আমরা নৌকার সঙ্গে বেইমানি করছি আসলে বিষয়টি তা না। জননেত্রী শেখ হাসিনা চান, এই নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ গ্রহণযোগ্য ও উৎসবমুখর হোক, আমার ভোট আমি যাকে খুশি তাকে দেব।

প্রার্থীদের আচরণবিধি ও নির্বাচনী আইন ভঙ্গের ধায়ে শুরুতে শোকজ দেওয়া, দোষী প্রার্থীকে সতর্ক করা এবং কিছু জায়গায় আচরণবিধি ভঙ্গে জরিমানা করলেও নির্বাচনের শেষ দিক এসে কঠোর হয়েছেন ইসি। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে বদলির হুমকি দেওয়ায় লক্ষ্মীপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান পবনের প্রার্থিতা বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। অভিযোগের ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার উপসচিব আব্দুছ সালাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে প্রার্থিতা বাতিলের সত্যতা পাওয়া যায়।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, নির্বাচনে নাশকতামূলক কার্যক্রম বা নির্বাচনবিরোধী যেকোনো প্রচেষ্টা নস্যাৎ করার সব প্রস্তুতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আছে। নাশকতাকারীদের সম্পর্কে তথ্য দিলে সর্বনিম্ন ২০ হাজার টাকা থেকে লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে এবং তথ্য প্রদানকারীর পরিচয় গোপন রাখা হবে। আইজিপি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রস্তুত আছে। ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব সময় মাঠে থাকবে।

নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আনিছুর রহমান বলেন, আমরা সর্বাধিক বিচারিক হাকিম নিয়োগ করেছি এবারের ভোটে। আমাদের উদ্দেশ্য একটাই, অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কোনো কারণে যদি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন না করতে পারি, যদি কোনো কারণে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমাদের রাষ্ট্র নিজেই ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়ে যাবে। আমরা সেটা চাইব না, কারণ আমরা সমগ্র বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। সুতরাং কোনোভাবেই এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেওয়া যাবে না।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email