বিশেষ প্রতিবেদক: ফাতেমা বেগম। রাজধানী যাত্রাবাড়ির বাসিন্দা। এই এলাকায় গ্যাসের সংকট দীর্ঘ দিনের হলেও শীত শুরু হওয়ার পর থেকে গ্যাস সংকট তীব্র। সন্ধার পর পাইপলাইনে গ্যাস আসলেও রান্না করার উপযোগী না। অপেক্ষা করতে হয় গভীর রাত পর্যন্ত। রান্না করার মত গ্যাস আসে রাত ১২ টার দিকে, থাকে ফজরের আগ পর্যন্ত। তাই বাধ্য হয়েই রাত জেগে রান্না করতে হয় বলে জানান ফাতেমা বেগম।

মেরাদিয়া এলাকার বাসিন্ধা আবু হানিফ জানান, তার এলাকায় রাত ১ টার পর গ্যাস আসে, থাকে রাত ৪ টা পর্যন্ত। গ্যাস সংকটের কারণে রাত জেগে রান্নার কাজ করতে হয়। গ্যাস না পেলেও বিল দিতে হচ্ছে ঠিকই। পাশাপাশি গ্যাসের অভাবে খাবার তৈরিতে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে করে ব্যয় বাড়ছে। আমাদের মতো বেসরকারি চাকরিজীবীদের ওপর এক প্রকার বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি।

নারায়ণগঞ্জ দেওভোগ এলাকার বাসিন্দা আবুল হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিগত অনেক বছর ধরেই গ্যাস সংকটে আমরা ভুগছি। এমপি-মেয়র সবাই আছে তবুও এই সংকট থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। এ নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। গ্যাস ব্যবহার করতে না পারলেও মাস শেষে আমাদের বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। গ্যাস না থাকার কারণে অনেকেই মাটির চুলা ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন।

মিরপুর-১০ এলাকার বাসিন্দা নিলুফার ইয়াসমিন জানান, বৈধ গ্যাস সংযোগ থাকার পরও ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছেন না। তাই বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার গ্যাস এবং রাইস কুকারে রান্না করতে হচ্ছে। আবার কেউ কেউ মাটির চুলা ব্যবহার করছে। গ্যাস সংকটের কারণে তার বাড়ির ভাড়াটিয়াদের মধ্যে অনেকেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এই গ্যাস সংকট দ্রুত সমাধান হবে আশা নিলুফার।

মগবাজার এলাকার মনিকা আক্তার বলেন, গ্যাস সংকটের কথা নতুন করে আর কি বলবো। আগে সকালে যাও কিছু গ্যাস আসতো। আর এখন গভীর রাতে গ্যাস আসে। আমি চাকরিজীবী মানুষ। রাত জেগে রান্না করলে দিনে অফিস করবে কে? বাধ্য হয়েই আমাকে সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হচ্ছে। তিনি দু:খ প্রকাশ করে বলেন, দুই বছর আগে ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা করে গ্যাসের সিলিন্ডার কিনতাম। দাম বাড়তে বাড়তে এ বছর ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা হয়। ১৫ দিন আগে সেই সিলিন্ডার কিনেছি ১ হাজার ৬০০ টাকায়। একদিকে মানুষের আয় দিন দিন কমছে, অন্যদিকে দ্রুত বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। এভাবে টিকে থাকা মুশকিল।

শুধু যাত্রাবাড়ি, মেরাদিয়া, নারায়ণগঞ্জ, মালিবাগ, মিরপুরই নয়, জুরাইন, মহাখালী, পল্লবী, কাফরুল, শেওড়াপাড়া, রায়েরবাগ, গ্রিন রোড, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, রামপুরা, বাসাবো, আরামবাগ, লালবাগ, পোস্তগোলা, উত্তরাসহ রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায়ই এখন এমন অবস্থা। দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাসাবাড়িতে গ্যাসের সরবরাহ থাকে না। কোথাও দুপুরের পর, কোথাও সন্ধ্যায়, আবার কোথাও গভীর রাতে মেলে গ্যাসের দেখা।

চলমান গ্যাস সংকট নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘প্রতিবছরই শীতে পাইপলাইনে পানি জমার কারণে গ্যাসের সংকট দেখা দেয়। এ ছাড়া এই সময়ে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় গ্যাসের চাহিদাও বেড়ে যায়। এবার এর সঙ্গে সরবরাহের অপ্রতুলতা যোগ হয়ে সংকট তীব্র হয়েছে। কারণ দেশের দুটি এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি সংস্কারের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। আরেকটি টার্মিনাল নিয়মিত সার্ভিসিংয়ে যাবে। সেটি মার্চ নাগাদ চালু হবে। এলএনজি টার্মিনালটি সংস্কার শেষে দেশে না আসা পর্যন্ত গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো পেট্রোবাংলার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, বছরজুড়েই থাকবে গ্যাসের সংকট। যদিও তা এখনকার মতো তীব্র হবে না। রেশনিং করে এই সংকট মোকাবিলার চিন্তা করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট পাওয়া যাচ্ছে আমদানিকৃত এলএনজি থেকে। এই হিসাবে ঘাটতি থাকছে ১ হাজার ৭৫০ মিরিয়ন ঘনফুট ঘাটতি থাকছে। মার্চে দুটি এলএনজি টামিনাল চালু হলে আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহে যোগ হবে। তারপরেও ঘাটতি থাকবে ১ হাজার ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট।

জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার সূত্রে জানা গেছে, আপাতত গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর কোনো উপায় না থাকলেও সংকট সমাধানে কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ২০২৬ সাল নাগাদ ৪৬টি কূপ খনন ও সংস্কারের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তাতে সফল হলে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট নতুন গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। এরই মধ্যে কয়েকটি কূপে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা পরিমাণে কম। এ ছাড়া বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের হাতে থাকা বিবিয়ানায় নতুন গ্যাসের মজুত পাওয়া গেছে। সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ এক দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এটি নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে এই গ্যাস উত্তোলন চলতি বছরের ডিসেম্বরের আগে করা সম্ভব হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী কূপ খনন ও সংস্কার করে কাঙ্ক্ষিত গ্যাস পাওয়া যাবে কি না, সেটা বলা যাচ্ছে না। এ ছাড়া নতুন করে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করতে যে বিপুল পরিমাণ ডলার দরকার সেটি জোগাড় করা না গেলে আমদানি ব্যাহত হবে। এ সময় দেশের পুরোনো কূপ থেকে গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে চাহিদাও বেড়ে যেতে পারে। ফলে চলমান সংকট কতটা দূর হবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি বছরের পুরো সময়টাই গ্যাস গ্রাহকদের সংকটের মধ্য দিয়েই কাটাতে হবে।

এমটি/ এএটি

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email