পোশাকসহ দেশের ৪৩ খাতে রফতানি আয়ে প্রণোদনা কমিয়েছে সরকার। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তাদের। রফতানি প্রণোদনা কমায় দেশের পোশাক খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস এম মান্নান কচি। একইসঙ্গে বন্ধ হয়ে যেতে পারে পোশাক খাতের ছোট ছোট কারখানা। দেশের অর্থনীতিতেও ধস নামার শঙ্কা রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের ব্যাংকের ওই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে বিকল্প সহায়তা দেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন বিজিএমইএ’র এই নেতা।
সম্প্রতি উত্তরায় বিজিএমইএ অফিসে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে এ সব কথা বলেন বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে থাকা এস এম মান্নান কচি।
প্রসঙ্গত, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুসারে স্বল্পেন্নাত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটলে রফতানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দেওয়া যাবে না। সে কারণেই সরকার এ বছর থেকেই রফতানিতে প্রণোদনা কমাতে শুরু করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
সিহা ডিজাইন (বিডি) লিমিটেডের চেয়ারম্যান এস এম মান্নান কচি। তিনি বিজিএমএই’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। বর্তমান সভাপতি ফারুক হাসান দেশের বাইরে থাকায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও দীর্ঘদিন ধরে জড়িত পোশাক খাতের এ নেতা। বর্তমানে তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বেও রয়েছেন।
এস এম মান্নান কচি বলেন, ‘যখন আমাদের সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে, তখন আমাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা ছাড়াই, কথাবর্তা না বলে নতুন সার্কুলার দিলো। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক আগে সার্কুলার দিয়ে জানিয়েছিল, জুন পর্যন্ত আমাদের প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে। আমরা সে অনুযায়ী অর্ডারগুলো নিয়েছি। প্রণোদনার ওপর ভিত্তি করে আমরা অর্ডার নিয়েছি। আমরা যে প্রণোদনা পেতাম, হঠাৎ করেই তার ৭০ শতাংশই বন্ধ করে দিয়েছে একটি সার্কুলারের মাধ্যমে।
তিনি বলেন, ‘তারা বলছে ৪ শতাংশের জায়গায় ৩ শতাংশ, ৩ শতাংশের জায়গায় ২ শতাংশ, ১ শতাংশের জায়গায় দশমিক ৫০ শতাংশ করেছে; কিন্তু এটি একটি ভাওতাভাজি। তারা যে আইটেমগুলোর কথা বলেছে সেই পাঁচটি আইটেম হলো টি শার্ট, টাউজার ও সোয়েটার এই তিনটি আমরা করি সাড়ে ২৩ বিলিয়ন ডলারে। পুরুষদের আন্ডারওয়ার ও শার্ট- এইসব মিলিয়ে আমরা ২৬ বিলিয়ন ডলার রফতানি করি। অর্থাৎ আমাদের মূল রফতানি টি শার্ট, টাউজার ও সোয়েটার- যে সোয়েটার করছে সে হয়ত সোয়েটারই করছে। যারা এককভাবে কোনো একটি পণ্য করে তারা এখন আর কোনো প্রণোদনা পাবে না। ছোট ও মাঝারি যারা ঘুরে দাঁড়াবে, এগিয়ে যাবে, তারাও এখন ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি বলব- এই প্রণোদনা কর্তনের ফলে বা যদি এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, তাহলে দেশের এই শিল্পে একটি বিপর্যয় নেমে আসবে এবং অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে এবং আমাদের অর্থনীতিতে একটি ধ্বস নেমে আসবে।
এস এম মান্নান কচি বলেন, আমি নীতি নির্ধারক বা সরকারের প্রতি অনুরোধ রাখব বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে, যে সার্কুলার দিয়েছে তা প্রত্যাহার করে, আমাদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে আমাদের একটি সময় বেঁধে দেওয়া হোক। যেহেতু ২০২৬ সাল, দুই বছর সময় রয়েছে, যাতে এটি ধাপে ধাপে কর্তন করা হয়। পাশাপাশি বিকল্পভাবে আমাদের সহায়তা দেওয়া হোক, এই শিল্পকে টেকসই করতে, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং করতে আর্থিক ও নীতি সহায়তা দেওয়া হোক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। চীন দিচ্ছে, ভারত ১০ হাজার কোটি টাকা এই শিল্পকে নীতি সহায়তা দিচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন নামে এই শিল্পকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। তাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে, এই শিল্পকে রক্ষা করতে হলে, অবশ্যই আমাদের জন্য এই সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে, সেটি যে নামেই রাখুক। আমি বলব, এই সার্কুলার প্রত্যাহার করে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিক- এটিই আমরা চাই।’
সরকারের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র এই নেতা বলেন, ‘বাণিজ্যমন্ত্রীসহ সকলের সঙ্গে আমরা আগামী রোববার মিটিং করব। অর্থমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমরা মিটিং করব। আমরা তাদের কাছে আমাদের বিষয়টি তুলে ধরব।’
নতুন বাজারে প্রণোদনা কমানোর বিষয়টি কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘নতুন মার্কেটগুলোকে প্রচলিত মার্কেটের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। অস্ট্রোলিয়া, জাপান ও ভারতকে এখন প্রচলিত বাজারের কাতারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি বলব এখন পর্যন্ত এই মার্কেটগুলো স্ট্যাবল (স্থির) হয়নি। আমেরিকা ও ইউরোপের মার্কেটে রফতানি করতে করতে বায়ারদের সঙ্গে শক্ত একটি অবস্থান তৈরি করেছি। কিন্তু নতুন বাজারগুলোতে আমাদের সেই অবস্থান তৈরি হয়নি। সবেমাত্র আমরা ধীরে ধীরে মার্কেটগুলোতে রফতানি বাড়াতে শুরু করতে পেরেছি। এই বাজারগুলোতে আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে। এই বাজারগুলোতে প্রণোদনা কমালে বাজার আর বড় হবেনা। বরং বাজারগুলোতে রফতানি ভবিষ্যতে আরও কমতে পারে।’
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে এস এম মান্নান কচি বলেন, ‘দেশের পোশাক খাতের উন্নয়নে সরকার দীর্ঘদিন ধরেই নানা সহায়তা দিয়ে আসছে। করোনাকালে ৪ মাসের বেতন দিতে সরকার নগদ সহায়তা দিয়েছিল। দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অতীতে সরকার যে ধরনের সহায়তা অব্যাহত রেখেছে এখন তা রাখতে হবে। বর্তমানে ৪৭ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি হচ্ছে। পোশাক শিল্প দেশের পুরো অর্থনীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। এই খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে খাতটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।’
মনে রাখতে হবে, সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায়, সরকারের নানা নীতি সহায়তার কারণে দেশের পোশাক খাতের আজকের এ অবস্থান। সবার প্রচেষ্টায় সম্মিলিতভাবে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। সবার আন্তরিকতা থাকলে অবশ্যই খাতটি আরও এগিয়ে যাবে।
এমটি/ এএটি