মহিউদ্দিন তুষার: দীর্ঘ ৩২ ঘন্টা পর নিভল নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জে গাজী গ্রুপের টায়ার তৈরির কারখানার আগুন। গতকাল মঙ্গলবার সকালের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। সকালের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও ভবনের ভেতরে দাহ্য পদার্থ থাকায় দুপুর পর্যন্ত ভেতরে কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে দেখা যায়। বেলা ১ টার দিকে পানি দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করেন। ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বরত কর্মীরা বেলা ৩ টার দিকে ভবনের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে ১ম থেকে ৪র্থ তলা পর্যন্ত যেতে পারেন। প্রচণ্ড গরমের কারণে ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলা যাওয়া সম্ভব হয়নি। ঝুঁকির কারণে মঙ্গলবারও অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান শুরু করতে পারেননি। তারা জানান, পোড়া ভবনের ছাদ থেকে পলেস্তারা ও ছাদের ঢালাই খুলে পড়ছে।

এদিকে গাজী টায়ার ফ্যাক্টরির বাইরে নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনরা উদ্বেগের সাথে অপেক্ষা করছেন। গত সোমবার দুপুরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা ভিড় জমাতে থাকেন। তখন ফায়ার সার্ভিস নিখোঁজের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। বেলা পৌনে ৩টা পর্যন্ত ১৭৩ জনের নিখোঁজের তালিকা করেছে ফায়ার সার্ভিস। তার পর থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত অনেকে আসলেও নিখোঁজদের নতুন তালিকা করেননি ফায়ার সার্ভিস। নিখোঁজদের মধ্যে মুড়াপাড়া দরিকান্দী গ্রামের মামুন, জহিরুল, জাকির হেসেন, স্বধীন, ইব্রাহিম, তারাবো পৌরসভার বরপা গ্রামের স্বপন, আসাদ, সোহাগ, আবু সাঈদ, মানিক, রতন, বকুল, জিন্নাত, মৈকুলী গ্রামের রাজ, ছাব্বির, ফয়েজ, সুজন। তাদের বয়স ১৫বছর থেকে ৪০ বছর বয়স। অন্যদের নাম পাওয়া যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, আগুন লাগার খবর পেয়ে আমরা কারখানার দিকে ছুটে আসি। ৬ তলা ভবনটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় প্রথম আগুন দেখেছি। ধীরে ধীরে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কারখানার ভেতরে অগনিত মানুষ দেখেছি, তা প্রায় তিনশতাধিক হবে। তারা সবাই হুড়োহুড়ি করে নামার চেষ্টা করছিল। আর বাঁচাও বাঁচাও বলে সবাই চিৎকার করছিলেন। ধোঁয়ার কারণে যখন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, তখন সবাই চিৎকার করছিল। অনেকে প্রাণ বাঁচাতে ভবনটির ছাদে চলে গিয়েছিলেন। আগুন লাগার প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা পরে ৯ জন লোক রশি বেয়ে নিচে নামতে সক্ষম হয়েছেন বলে জানান তারা।

কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, গাজী গ্রুপের মালিক গোলাম দস্তগীর গাজী আওয়ামী লীগের সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী রোববার ভোররাতে ঢাকার শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পরপরই রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে আনন্দ মিছিল বের হয়। একপর্যায়ে ২০০ থেকে ২৫০ জনের একটি দল কারখানার ভেতরে ঢুকে শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বের করে দিয়ে গেট আটকে দেয়। এরপরই লুটপাট শুরু করে। যে যার মতো জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছিল। তারা জানান, টায়ার তৈরির জন্য বিভিন্ন কেমিক্যাল, কাঁচামালসহ প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকার মালামাল ছিল ভবনটিতে। লুটপাট শেষে রাত ৯টার দিকে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এ সময় লুটপাটকারী আটকা পড়ে ভবনের ভেতরে। পরে তাদের উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। তারা বলেন, এবারই প্রথম না, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর ৫ আগস্টও লুটপাট শেষে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। তখন কারখানাটির ৫ থেকে ৬টা শেড পুরোপুরি পুড়ে যায়। এখন আমরা ভবনটির ভেতরে কাজ করছিলাম। সেটাও পুড়িয়ে দিয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, ভেতরে থাকা টায়ার উৎপাদনের দাহ্য পদার্থ ও কাঁচামালের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়েছিলো। রোববার রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে স্থানীয়দের মাধ্যমে আগুন লাগার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিস। ঢাকা ফুলবাড়িয়া ফায়ার স্টেশন, ডেমরা, কাঁচপুর, আদমজী ইপিজেড ও কাঞ্চন ফায়ার স্টেশন থেকে একে একে যোগ দেয় ১২টি ইউনিট। অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে থেমে থেমে বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি। এতে আশপাশের এলাকায় শিল্প কারখানা ও বাড়িঘরের লোকজনের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করে। ফায়ার সার্ভিসের সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণে নারায়ণগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশও কাজ করেছে।

কারখানা পরিদর্শ শেষে শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা এখানে ভলান্টিয়ারের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, এখানে মূলত যন্ত্রাংশসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র চুরি ও লোপাট শুরু করেছিল দুর্বৃত্তরা। তাদের মধ্যে দুটো গ্রুপ তৈরি হয়েছিল। গ্রুপ দুটোর মধ্যে স্বার্থের হানাহানি থেকে এক্সপ্লোশন সৃষ্টি হয়। এই বেশ বিরাট আকারের এক্সপ্লোশন হয়েছে।

কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে বিএনপির কার্যনির্বাহী সদস্য ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী মনিরুজ্জামান বলেন, গাজী টায়ারের মালিক সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতিক গ্রেফতার হয়েছে। প্রচলিত আইনে তার বিচার হবে। তার এই কারখানায় রূপগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ১৪/১৫ সহস্রাধিক শ্রমিক কর্মচারী চাকরি করেন। কারখানায় আগুন, লুটপাট ও হতাহতের ঘটনায় বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। এই ঘটনায় বিএনপির কেউ জড়িত থাকলে সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। কারখানাটি টিকিয়ে রাখার জন্য সকলকে এগিয়ে আসা উচিত।

এমটি/ এএটি

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email