মহিউদ্দিন তুষার: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৩৬ দিনের মাথায় আওয়ামীলীগ সরকারের পতন হয়। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছাড়েন দলের সভানেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৫ আগস্ট থেকেই দেশজুড়ে বসতভিটা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ওপর হামলা চালিয়েছে বিভিন্ন সুযোগ সন্ধানী গোষ্ঠী। সেই সঙ্গে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে বিএনপিপন্থীদের দখল উৎসব ও চাঁদাবাজি অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পর আত্মগোপনে রয়েছে আওয়ামীলীগের দোসররা। কেউ কেউ দলের শোককে শক্তিতে পরিণত করে বিএনপিপন্থীদের যোগসাজশে দখল, চাঁদাবাজিতে অংশ নিচ্ছে। আবার কেউ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ছবি ব্যবহার করে পোষ্টার বানিয়ে ফেসবুকে প্রচার করছেন।
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দলীয়ভাবে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) শীর্ষ নেতারা। তার পরেও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা আর্থিক বিনিময়ে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের সাথে ‘সমঝোতা’ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সেই তালিকায় ঢাকা জেলা ও মহানগর, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, শরীয়তপুরসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার নামও এসেছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীরা। তবে অভিযুক্তরা বলছেন, রাজনৈতিকভাবে তাদের ঘায়েল করতে দলের ভেতর থেকে কেউ কেউ মিথ্যা অভিযোগ তুলছে।
এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের ১৪টি বিলাবহুল গাড়ি সরাতে সহায়তা করার অভিযোগ উঠেছে তিন বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে। সে ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর দলের তিন নেতাকে শোকজ করেছে বিএনপি। কারণ দর্শানোর নোটিশ পাওয়া নেতারা হলেন-চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম এবং কর্ণফুলী থানা বিএনপির আহ্বায়ক এসএম মামুন মিয়া। জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে নগরীর কর্ণফুলী থানাধীন মইজ্জারটেক এলাকার ওই কারখানা থেকে এই গাড়িগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। এস আলমের সম্পদ কাউকে না কেনার এবং তাতে হাত না দেওয়ার ঘোষণা সরকারের তরফ থেকে আসার পর অস্থাবর সম্পদ এভাবে সরিয়ে ফেলা হয়। গাড়ি সরানোর সময় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্মসম্পাদক এনামুল হক এনাম, কর্ণফুলী থানা বিএনপির আহ্বায়ক এসএম মামুন মিয়া ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানের গাড়িচালকসহ বিএনপির বেশকিছু নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও ফুটেজে রাতের আঁধারে কারখানা থেকে একের পর এক বেশ কয়েকটি গাড়ি বের হতে দেখা যায় এবং এনাম ও মামুনের উপস্থিতিও দেখা গেছে।
চট্টগ্রামে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের গ্রুপের গাড়ি ব্যবহারের জন্য সালাউদ্দিন আহমেদকে এবং বিতর্কিত ডায়মন্ড ব্যবসায়ী দিলিপ কুমার আগারওয়ালার সঙ্গে বৈঠকের অভিযোগে খোকনকে শোকজ করা হয়েছে। গতকাল সোমবার বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে অনিচ্ছাকৃত ভুলে এস আলমের গাড়ি ব্যবহার করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘ ১০ বছর পর আমার নিজ নির্বাচনী জেলায় সংবর্ধনা অংশ নিয়েছিলাম। আমি বিমানবন্দর থেকে নেমে কোনো গাড়িতে করে যাবো, সেটা তো আমি ঠিক করতে পারি নাই। যারা সংবর্ধনা আয়োজন করেছিল চকরিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ঠিক করে দিয়েছে। তিনি বলেন, বিমানবন্দরে নামার পর আমাদের নেতাকর্মীরা বলছে-এই গাড়িতে উঠেন। এখন সেই গাড়িটি কার তা খোঁজ নেওয়ার চিন্তা-ভাবনার মধ্যে ছিলাম না। ১০ বছর পর নিজ জেলায় যাচ্ছি, তাই আবেগপ্লুত ছিলাম। মনের মধ্যে বাসনা ছিল কখন মা-বাবার কবর জিয়ারত করব।
শরীয়তপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সরদার একেএম নাসির উদ্দীন কালুই এখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর আশ্রয়স্থল হয়ে দাড়িয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাকে ঘিরেই আওয়ামী লীগের একটি অংশ বিএনপিতে অনুপ্রবেশের জন্য মুখিয়ে রয়েছে। এ নিয়ে শরীয়তপুরে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দলীয় সিদ্ধান্ত তোয়াক্কা না করে এসব কর্মকান্ড করায় সাবেক এই এমপির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনাসহ ওই সরকারের পতনের পর বিএনপি নেতাকর্মীরা উৎফুল্ল। এই সুযোগে শরীয়তপুরে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী বেশ কিছু নেতাকর্মী বিএনপিতে যোগদান করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকলেও তার তোয়াক্কা করছেন না সরদার একেএম নাসির উদ্দীন কালু। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৭ আগস্ট বিকালে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা ইউনিয়নে প্রয়াত বর্ষিয়ান আওয়ামী লীগ নেতা নাসির উদ্দীন জমাদ্দারের ছেলে জাজিরা উপজেলা ছাত্র লীগের সহ-সভাপতি নাজমুল জমাদ্দারের বাড়ির উঠানে এক বিশাল সমাবেশে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল গোমস্তার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, সরদার একেএম নাসির উদ্দীন কালু।
নোয়াখালী-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী ও তার ভাগনে রায়হানকে মোটা অংকের টাকা ও কোটি টাকার গাড়ির বিনিময়ে জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম হায়দারের যোগসাজশে বাড়িতে থাকার সুযোগসহ রক্ষা করার অভিযোগ উঠেছে। কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে সংঘর্ষ ও অনুপ্রবেশকারী নিয়ে বিএনপির দু’পক্ষ একে অন্যের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছে। উভয় পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার কথা বলছে। অভিযোগ অস্বীকারও করছেন নেতাকর্মীরা। উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য সচিব মো. বায়োজিদ মণ্ডল বলেন, তারা ১৫ বছর ধরে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। এখনও অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে সুযোগ-সুবিধা, পদ-পদবি নিয়েছে। এখন অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে হামলা-ভাঙচুর করছে।
পটুয়াখালীতে জেলা বিএনপির দুই পক্ষের নেতারা পৃথক সংবাদ সম্মেলন করে পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছেন। নেতারা বলেন, গত ৩০ আগস্ট আলতাফ হোসেন চৌধুরী জেলা কমিটিকে না জানিয়ে বিএনপির নামে জনসমাবেশ করেন। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ওয়াহিদ সরোয়ারকে পাশে নিয়ে একই মঞ্চে সমাবেশ করেছেন আলতাফ হোসেন চৌধুরী। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে একাধিক সময়ে কাজ করেছেন আলতাফ। তিনি ও তাঁর অনুসারী নেতা-কর্মীদের ছত্রচ্ছায়ায় বিএনপির ভেতরে অনেকে অনুপ্রবেশ করে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ বিভিন্ন অপকর্ম করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, যে সমস্ত হাইব্রিড নেতা-কর্মী গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ করেছেন, তাদের যদি বিএনপির উপজেলা, ইউনিয়ন বা ওর্য়াড পর্যায়ের কোনো নেতা আবার বিএনপিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে কিংবা বিএনপি করানোর চেষ্টা করে আগে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি দলের নেতা-কর্মীদের হুঁশিয়ারি করে বলেন, আমরা দলের প্রত্যেকটি নেতা-কর্মীর কষ্টকে সম্মান করি, আপনাদের ত্যাগকে সমীহ করি কিন্তু দলের বিরুদ্ধে, দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, এমন কাজে কেউ লিপ্ত থাকে ও বিএনপির নামে কেউ যদি চাঁদাবাজি করার চেষ্টা করে তবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমটি/ এএটি