* ইন্ধন দিচ্ছে প্রশাসনের বাইরে থাকা একটি বিশেষ মহল
* অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা দুর্নীতির অভিযোগ, তবুও পদে বহাল
* প্রশাসনে সংস্কার যত বিলম্বিত হবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের জন্য ততই ঝুঁকিপূর্ণ
মহিউদ্দিন তুষার: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপাকে ফেলতে একের পর এক ষড়যন্ত্র এবং সুকৌশলে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে সরকারি চাকরিতে থাকা কিছু কর্মকর্তা। এর পেছনে ইন্ধন দিচ্ছে প্রশাসনের বাইরে থাকা একটি বিশেষ মহল। শেখ হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য করে ছাত্র আন্দোলনের যে প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়েছে, সেটি প্রতিহত করে বিজয়ের সুফল ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টার অংশ হিসেবে দাবি আদায়ের নামে বিভিন্ন সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ভয়ঙ্কর সব ষড়যন্ত্রে মেতেছে।
নতুন সরকারকে কোনো ধরনের সময় বা সুযোগ না দিয়েই রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত কিছু ব্যক্তিবর্গ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের এই অবস্থান। অবৈধভাবে অর্থ ছড়িয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে উত্তেজিত করে রাজপথে নামানো হচ্ছে। আনসার সদস্যদের অযাচিতভাবে আচরণ, শাহবাগে পায়েচালিত রিকশাওয়ালাদের আন্দোলন, দাবি-দাওয়ার নামে বিভিন্ন সংগঠনের সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন, সারাদেশে সব চিকিৎসাকেন্দ্রে কর্মবিরতির ডাক “কমপ্লিট শাটডাউন” গাজীপুরে চাকরির দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের ব্যানারে বিক্ষোভ ষড়যন্ত্রে অংশ হিসেবে দেখছেন বিশিষ্টজনরা।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে তুরুপের তাস হয়ে কাজ করেছেন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পাশাপাশি প্রশাসনের কর্মকর্তারা। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় থেকে শুরু করে দেশের ৬৪ জেলায় ছিলো তাদের বিচরণ। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও দফতরের শীর্ষ কর্তাদের সরাতে পারলেও এখন অনেকেই রয়েছে বহাল তবিয়তে। যারা বর্তমান সরকার নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রের কাজ করছে। অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা দুর্নীতির অভিযোগ, তবুও পদে বহাল।
শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত আমলাদের মধ্যে এখনও বহাল তবিয়তে আছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তিনি ২০২৩ সালের ৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে যোগদান করেন। বিশ্বস্ততার এই তালিকায় রয়েছেন আইন ও বিচার বিভাগের বিতর্কিত সচিব মো. গোলাম সারওয়ার, পানি সচিব মন্ত্রণালয় সচিব নাজমুল আহসান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সচিব ফরিদ আহাম্মদ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সচিব মোহাং সেলিম উদ্দিন। তারা সবাই স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ে বহাল রয়েছেন।
অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ১১৭ জন ‘বঞ্চিত’ সিনিয়র সহকারী সচিব পদ্মোন্নতি পেয়ে উপসচিব হয়েছেন। একইভাবে যুগ্ম সচিব হিসেবে ২০১ জন ও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন ১৩১ জন কর্মকর্তা। অভিযোগ উঠেছে, এসব কর্মকর্তার মধ্যে অনেকেই আছেন যারা আওয়ামী লীগ প্রশাসনে নানা সুবিধা নিয়েছেন। অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এনবিআর চেয়ারম্যানসহ ১১ জন সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল হয়েছে। চলতি দায়িত্বে থাকা একাধিক সচিব ওএসডি হয়েছেন। বর্তমান প্রশাসনে সিনিয়র সচিব, সচিব ও সমমর্যাদার আরো ৫০ অধিক কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ প্রশাসনের সুবিধাভোগী এসব কর্মকর্তাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেও পুনর্বাসন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আরো অভিযোগ, সম্প্রতি উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের অনেকেই দুর্নীতিবাজ ও আওয়ামী লীগ প্রশাসনের সুবিধাভোগী। পদোন্নতি দিয়ে তাদেরও পুনর্বাসিত করা হচ্ছে।
সচিবালয়ে একাধিক মন্ত্রণালয় ঘুরে দেখা যায়, বড় আমলাদের রুমে সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীদের একান্ত সচিবদের (পিএস) আনাগোনা বেশি। চা চক্রের সাথে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করছেন। অনেকে অফিস করলেও দায়সারা কাজ করে দিন পার করছেন। এক মন্ত্রণালয়ে তিন দফতরের সচিবকে দেখা যায়। আরেকটি মন্ত্রণালয়ে ১ ঘন্টা অপেক্ষার পরেও পাওয়া যায়নি ঐ সচিবকে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন হলেও এখনো জনপ্রশাসনে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান। তিনি বলেন, জনপ্রশাসনের মৌলিক কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না, আগের সরকারে যারা কাজ করেছেন তারা এখনো বহাল আছেন।
দায়িত্বশীল কর্মকতারা বলেন, অন্তবর্তীকালীন সরকারের তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও পুরো প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো যায়নি। পুরোনো আমলাদের সরানো তো যায়নি বরং বিভিন্ন সংস্থায় নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রেও ঢুকে পড়ছেন হাসিনার বিশ্বস্ত অনেকেই। তবে প্রশাসনে সংস্কার যত বিলম্বিত হবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের জন্য তা ততই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। একই সাথে, সরকারকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সকল প্রকার মিছিল, মিটিং, সমাবেশ এবং প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে, যাতে নতুন সরকারের ওপর কোনো ধরনের চাপ সৃষ্টির সুযোগ না থাকে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বলেন, আমরা আশা করি, জনগণের এই সরকার সমস্ত বাধা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশের উন্নয়নের পথে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যাবে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে এই অন্তবর্তীকালীন সরকার, যাদের প্রতি জনগণের সহায়তা এবং সমর্থন রয়েছে, অবশ্যই স্বৈরাচারের কালো ছায়া পেছনে ফেলে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। কোন অপশক্তিই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।