মহিউদ্দিন তুষার: শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল হয়েছিল। পরে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল করে। আপিল বিভাগও হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখে। কিন্তু ছাত্ররা কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে ২০১৮ মতই আন্দোলনে নামে। ছাত্র ও জনতার ২৩ দিনের দেশ কাঁপানো আন্দোলনে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ থেকে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা।
সরকারি তথ্য বলছে, সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি চালুর ইতিহাসটি বেশ দীর্ঘ। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ২০ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হতো। বাকি ৮০ শতাংশ পদে কোটায় নিয়োগ হতো। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এই অগ্রাধিকার কোটার মধ্যে রয়েছে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা কোটা ও ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। পরে ১ শতাংশ পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণের নিয়ম চালু করে মোট কোটা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশ। শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল। পরে এ কোটায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তারপর নাতি-নাতনি যুক্ত করা হয়। ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থার কারনে দেখা যায় অনেকে সকল ক্ষেত্রে পাশ করেও চাকরি পায়নি। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা মোটা ব্যবস্থার উপর সাধারণ চাকরি প্রাপ্তিদের ক্ষোভ প্রকাশ পায় ২০১৮ সালে। পরে ২০২৪ সালে তাদের বিজয় হয়।
কয়েক দশক ধরেই মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন চলছে। আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেই (২০১৯ থেকে ২০২৩) নতুন করে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির জন্য ১০ হাজার ৮৯১ জনের নাম সুপারিশ করেছিল জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। গেজেটভুক্তির জন্য অনেকের নামে সুপারিশ করেছেন সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা। সুপারিশকারীদের মধ্যে জামুকার সদস্যরাও রয়েছে। এরও আগে ২০০৯ থেকে ২০১৪ এই পাঁচ বছরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পেশার মোট ১১ হাজার ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছিলেন। এ যেন এক অন্তহীন প্রক্রিয়া।
যতটুকু জানা যায়, স্বাধীনতার পর অন্তত সাতবার মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। আর বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার। কিন্তু চূড়ান্ত কোনো তালিকা এখন পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। ফলে নিরূপণ করা যায়নি মুক্তিযোদ্ধার সঠিক সংখ্যাও।
মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার। অর্থাৎ মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে জেলা ও উপজেলা কমান্ডারদের নেতৃত্বে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে প্রণীত একটি তালিকা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে সংরক্ষণ করা হয়। তাতে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়। এর পর ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও ২০০৩ ও ২০০৪ সালে দুটি পৃথক তালিকা প্রকাশ করে। তাতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার। ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয় ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৭।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রায় আট হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করলেও প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে সনদ নেয়ার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। এমনকি তাদের মধ্যে যারা সরকারি ভাতা গ্রহণ করেছে সেই টাকাও ফেরত আনার কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের পরিপত্র অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার (গেজেটভুক্ত) বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস ছিল, তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সে হিসাবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনম বয়স হবে সাড়ে ৬১ বছর।
জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, তাঁদের কারও জন্ম ১৯৮২ সালে, কারও আবার ১৯৯১ সালে। এরপরও তাঁদের নাম রয়েছে ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়। এমন প্রায় দুই হাজার জনের তথ্য পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, যাঁদের জন্ম (পরিচয়পত্রের তথ্যে) মুক্তিযুদ্ধের পরে। তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
আন্দোলন চলাকালে প্রধান একটি বক্তব্য ছিল, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কতজনের চাকরি হয়েছে, তার একটি তালিকা প্রস্তুত করা হবে। তালিকা প্রস্তুতির পর দেখা হবে তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কি না, ন্যায্যভাবে হয়েছে কি না দেখা হবে। প্রায় তিন হাজার ৭০০ র মতো মামলা আছে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। মুক্তিযোদ্ধা কারা, তা নির্ধারণ করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়ন করে।
বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ শোনা গেছে। এমনকি বাংলাদেশে ভুয়া বা অ-মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ঠিক কত, সে বিষয়ে এখনও পরিষ্কার তথ্য নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৮৩ হাজারের সামান্য বেশি। তবে এর মধ্যে এখন বেঁচে আছেন প্রায় এক লাখ।
নাম প্রকাশে অনিশ্চুক এক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংগ্রাম করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা প্রধান হয়ে উঠে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তি ক্ষুর্ণ হয়েছে। একটা সুবিধাভোগী শ্রেণি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করেছে বিগত স্বৈরাচারী ব্যবস্থা। সেই কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগকে পুনর্গঠনের জন্য সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের মতামত নিয়ে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ না করেও যারা মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি কেউ মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযুদ্ধের সুবিধা গ্রহণ করেন, এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
উপদেষ্টা বলেন, বিগত আন্দোলনে একটা প্রধান বক্তব্য ছিল মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটা। সরকারি এবং আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কতজনের চাকরি (মুক্তিযোদ্ধা কোটায়) হয়েছে, এর একটি তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তালিকা প্রস্তুত হওয়ার পর আশা করি আমরা আপনাদের সামনে হাজির হবো। পুরো বিষয়টি জানাবো।
প্রসঙ্গ, ২০১৪ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেয়া শুরু করে সরকার। প্রথমে ২০ হাজার জন মুক্তিযোদ্ধাকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে ভাতা দেয়া হতো, যা পরে বিভিন্ন সময় বাড়ানো হয়েছে। এখন মুক্তিযোদ্ধারা মাসে বিশ হাজার টাকা করে সম্মানী পান। সম্প্রতি এ টাকা ত্রিশ হাজারে উন্নীত করার জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি চাকরিজীবী হলে এখন দুই বছর বেশি চাকরি করার সুযোগ পাচ্ছেন। এছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসা, আবাসন ও রেশনসহ নানারকম সুযোগ সুবিধা আছে। এসব সুবিধা পেতে অনেকেই এখন মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আসতে চান বলে অভিযোগ আছে।
এমটি/ এএটি