#বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ৩০ বছর #প্রতিবেশী আট দেশে ৩৫-৪৫ #যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ৪০- ৫৯ #শ্রীলঙ্কায় বেকাররা ৪৫ বছর #কোনও কোনও দেশে উন্মুক্ত

মহিউদ্দিন তুষার
সরকারি চাকরিতে বয়স বৃদ্ধি নিয়ে গেল দুই দশক ধরে আন্দোলন হয়ে আসছে। ২০১২ সাল থেকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ৩৫ বছর করার দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে। সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদও এই দাবি তুলে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে অনেকবার। তবে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের সময়ে এই দাবি মানেনি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকারের পতন হলে এই দাবি নিয়ে শিক্ষিত তরুণরা আবার রাস্তায় নামে। এর পরই বিষয়টি নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে প্রতিক্রিয়া আসে।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নির্ধারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মূয়ীদ চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয় সরকার। চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির দাবির যৌক্তিকতা আছে। এখনকার বয়স যেটি আছে, তা বাড়ানো উচিত। তবে কতটুকু করা যৌক্তিক, তা সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে চিন্তা করা হবে। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় মুয়ীদ চৌধুরী এ কথা বলেন।

সর্বশেষ ১৯৯১ সালে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয়। এরপর ২০১১ সালে অবসর গ্রহণের বয়স ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ করা হয়। বিভিন্ন সময় আন্দোলনকারী প্রার্থীরা আমরণ অনশনের মতো কর্মসূচি নিলেও বিধায়ী সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া আসেনি। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ২০১১ সালে ছিল ৭০ বছর। তা এখন বেড়ে ৭৪ বছরের কাছাকাছি হয়েছে। এই যুক্তিতে চাকরির অবসরের বয়সও নতুন করে বাড়াতে চান অনেকে।

আন্দোলনকারীদের দাবি, উন্নত বিশ্বসহ বেশিরভাগ দেশেই চাকরির বয়সসীমা বেশি। চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাংলাদেশের চেয়ে ১৬২ দেশে বেশি। আর প্রতিবেশী আট দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫-৪৫। শুধু বাংলাদেশ-পাকিস্তানে ৩০। বিভিন্ন দেশের চাকরির বয়সসীমার তথ্য পর্যবেক্ষেণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বর্তমান বয়সসীমা বিশ্বের ১৬২টি দেশের সর্বনিম্ন বয়সের চেয়েও পাঁচ বছর কম। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো উন্নত দেশে চাকরির সর্বোচ্চ বয়স ৪০ থেকে ৫৯ বছর।

হাতে গোনা বিশ্বের কয়েকটি দেশে চাকরির সর্বনিম্ন বয়স ৩৫ বছর হলেও, বাংলাদেশে তার চেয়েও কমিয়ে ৩০ বছরে রাখা হয়েছে। দেশের গড় আয়ু, মাথাপিছু আয়সহ সার্বিক সূচক বাড়লেও বাড়ানো হয়নি এ সীমা। যা দেশের লাখো বেকারের বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ কারণে চাকরির সর্বোচ্চ বয়স ৩৫ করার জোর দাবি তুলেছে হাজারো চাকরি প্রত্যাশী। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া সাধারণ ছাত্র পরিষদের দেয়া এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৫৯ বছর।

ভারতে (পশ্চিমবঙ্গ) বয়সসীমা ৪০ বছর। বিভিন্ন দেশের মানদণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৬২টি দেশে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর। কোনও কোনও দেশে এটি উন্মুক্ত। প্রতিবেশী অন্তত ৮ দেশে এ বয়সসীমা ৩৫ থেকে ৪৫ বছর।

বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে এ বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়, যা এখনো কার্যকর রয়েছে। ভারতে রাজ্যভেদে ও চাকরির ধরন অনুযায়ী আবেদনের বয়সসীমা ৩২-৪২ বছর পর্যন্ত। প্রশাসনিক সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে হলে ন্যূনতম ২১-৩২ বছর বয়স হতে হয়। তবে কোটায় ৪২ বছর বয়স পর্যন্ত করা যায়। অনগ্রসর শ্রেণির জনগণ ৩৫-৩৭ বছর বয়স পর্যন্ত আবেদন করতে পারে।

নেপালে গেজেটেড ও নন গেজেটেড পদে আবেদন করার ক্ষেত্রে পুরুষের ন্যূনতম বয়স হতে হবে ১৮ বছর এবং সর্বোচ্চ ৩৫ বছর। তবে নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ৪০ বছর পর্যন্ত আবেদন করতে পারেন। গেজেটেড পদ শাখা কর্মকর্তা, উপসচিব এবং যুগ্ম সচিব বা এ ধরনের পদে ন্যূনতম ২১ বছর এবং সর্বোচ্চ ৩৫ বছর পর্যন্ত আবেদন করা যায়। এ পদে মহিলা ও প্রতিবন্ধীরা ৪০ বছর পর্যন্ত আবেদন করতে পারেন।

নেপালে শূন্য পদের উপ ও যুগ্ম সচিব পদে ৪৫ বছর পর্যন্ত আবেদন করার বিধান রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার প্রাথমিক স্তরের পদে সর্বনিম্ন ১৮ বছর এবং সর্বোচ্চ ৪৫ বছর পর্যন্ত আবেদন করা যায়। অফিসার পদে সর্বনিম্ন ২১ ও সর্বোচ্চ ৪৫ বছরের ব্যক্তিরাও আবেদন করতে পারেন। শ্রীলঙ্কায় স্নাতক পাস করা বেকাররা সরকারের যে কোনো কর্মসূচির অধীনে ৪৫ বছর পর্যন্ত আবেদন করতে পারেন।

আগে এ সীমা ছিল ৩৫ । তবে সরকারি চাকরির সব ক্যাটাগরির জন্য এ বয়সসীমা প্রযোজ্য নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানে ৩৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে আবেদন করার নিয়ম রয়েছে। আফগানিস্তানে বয়সসীমা ৩৫ বছর। আর মালদ্বীপে সর্বোচ্চ ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত সরকারি চাকরির আবেদন করা যায়। যথাক্রমে ইন্দোনেশিয়াতে চাকরির বয়স ৪৫ বছর রেখেছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর। বাংলাদেশে বয়স ৩০ হলেই সরকারি চাকরির আবেদন করা যায় না। অবশ্য কোটা থেকে আবেদন করা যায় ৩২ বছর পর্যন্ত। তবে সরকারি নার্সিংয়ের ৩৫ বছর এবং বিভাগীয় প্রার্থী কোটায় ৩৫ বছর পর্যন্ত আবেদন করা যায়। এছাড়া চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ৫৫ বছর রাখা হয়েছে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে।

এসব দেশের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, অস্ট্রেলিয়া, মালায়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার, ওমান, কুয়েতসহ বেশ কয়েকটি দেশ। একমাত্র দেশ সুইডেন চাকরির বয়স ৪৭ বছর রেখেছে। বাংলাদেশে যখন চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা ৩০ বছর করা হয়, তখন মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। বর্তমানে গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭৩ বছর। এরপর বয়স বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন হলেও কোনো সরকারই ভ্রুক্ষেপ করেনি।

এ জন্য বিভিন্ন সময়ে নানা ব্যাখ্যা দিয়েছে সরকার। বিশ্বের উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের সবকিছু যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন চাকরির এ বয়সসীমা ৩০ বছরে আটকে রাখাকে নিজেদের জন্য দুর্ভাগ্য বলে মনে করছেন চাকরি প্রত্যাশী হাজারো শিক্ষিত যুবক। তবে, সরকার চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির দাবি পর্যালোচনায় কমিটি গঠন করায় পরিস্থিতি বদল হতে পারে।

আন্দোলনকারীরা মনে করছেন, বাস্তবতা মেনে সরকার তাদের দাবি বিবেচনা করবে। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হচ্ছে। একইসঙ্গে বাড়ানো হতে পারের চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমাও। সরকারের নীতি নির্ধারক সূত্র বলছে, ব্যাপারটি নিয়ে সরকার কাজ করছে। যেকোন সময় সরকারি চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হতে পারে বলে জানা গেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ৩৫ কিংবা ৬৫ কোনোটাই যৌক্তিক না। ৩২ এবং ৬০ নিয়ে ভাবা যেতে পারে।

এমটি/ এএটি

 

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email