থেমে আছে মামলার তদন্তকাজ
এখনও আতঙ্ক কাটেনি পুলিশে
উদ্ধার হয়নি লুট হওয়া অস্ত্রের বেশির ভাগই
দায়িত্ব পালন করতে নানামুখী শঙ্কা
মহিউদ্দিন তুষার
প্রবল গণ আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতার রোষানলে পড়েন পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ সদর দপ্তরসহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ২১টি থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। শুধু থানাই নয় নরসিংদীতে জেলা কারাগারে দেয়া হয় আগুন। কারাগার ভেঙে ৯ জন জঙ্গিসহ ৮২৬ বন্দি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অধীন থানা রয়েছে ৫০টি। ৫ ও ৬ আগস্ট ২১টি থানাসহ পুলিশের ২১৬টি স্থাপনায় হামলা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। আগুনে পুড়ে যায় মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, আদাবর, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, পল্টন, শেরেবাংলা নগর, শ্যামপুর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, ভাটারা, ওয়ারী ও খিলক্ষেত থানা। পুড়িয়ে দেওয়া হয় পুলিশের বেশ কিছু টহল গাড়িও। থানায় আগুন দেওয়াতে ভেতরে থাকা জিনিসপত্রসহ মামলার নথি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যার কারনে পড়তে হচ্ছে নানান সমস্যায়।
পুলিশ সূত্র জানায়, আগুনে মোহাম্মদপুর থানার ৮৯টি মামলার নথি পুড়ে গেছে। বাড্ডা থানায় ১৩৭টি মামলার নথি ও ১৬০টি মামলার আলামত পুড়ে যায়। শেরেবাংলানগর থানায় মামলার সব নথিপত্র এবং দেড় শর মতো আলামত পুড়ে গেছে। ওয়ারী থানার ৭৪টি মামলার নথি এবং ২১৫টি মামলার আলামত পুড়ে গেছে ও লুট হয়েছে। শ্যামপুর থানায় পুড়ে গেছে ২৩৯টি মামলার আলামত।
মিরপুর মডেল থানার পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঐ থানায় ৬৬০টি মামলার নথিপত্র এবং মালখানায় থাকা বিভিন্ন মামলার ২৩০টি আলামত পুড়ে গেছে। থানা ভবনে থাকা নিবন্ধন (রেজিস্টার) খাতাও পুড়ে গেছে। বিভিন্ন মামলার কেস ডকেট (সব নথিপত্র) পুড়ে গেছে।
যাত্রাবাড়ী থানার মামলার নথিপত্র সংরক্ষণ করা কম্পিউটার পুড়ে যাওয়ায় ওই সব মামলার নথিপত্রের তালিকা এখনো তৈরি করা যায়নি। এ ছাড়া বাড্ডা, আদাবর, ওয়ারী এবং শ্যামপুর ও শেরেবাংলানগর থানার এক হাজার ১০০টি মামলার আলামত পুড়ে গেছে বলে জানা যায়।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, এখনও পুলিশের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি। বাইরে দায়িত্ব পালন করতে গেলে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। লুট হওয়া অস্ত্রের বেশির ভাগ এখনো উদ্ধার করা যায়নি। এ কারণে কাজ করতে খুব সমস্যা হচ্ছে। তারা জানান, আগুনে থানায় রাখা সব নথিপত্র পুড়ে গেছে। যা ফেরত আনা সম্ভব নয়। এখন আর আমাদের কাছে পুরনো কোনো মামলার আলামত নেই। ফলে আগের মামলার তদন্তকাজ অনেকটাই থেমে আছে। থানার নিয়মিত কার্যক্রম (নাগরিক সেবা) পুরোপুরি এখনও স্বাভাবিক হয়নি।
ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২১টি থানায় হামলা এবং ১৩টি থানায় অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লুট করা হয়েছে অস্ত্র। এসব থানার মামলার নথিপত্র, পোশাক, গাড়ি ধ্বংসের পাশপাশি হাঁড়ি-পাতিল পর্যন্ত লুট করা হয়েছে। এর মধ্যে তিন মাস পার হতে চললেও এখনো এসব থানার কার্যক্রম স্বাভাবিক করা যায়নি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এখনো এসব থানার বাইরে আঙিনায় পড়ে আছে পোড়া গাড়িসহ অন্যান্য আসবাবের ধ্বংসস্তূপ। এর মধ্যে পুলিশের পোশাকও রয়েছে। থানার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজের ধ্বংসস্তূপও পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
কথা বলে জানা গেছে, অগ্নিসংযোগ করায় এসব থানার মামলা ও নথিপত্রের পাশাপাশি কম্পিউটারও পুড়ে যায়। এসব কম্পিউটারে রক্ষিত ছিল গুরুত্বপূর্ণ অনেক নথিপত্র। ভাটারা, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, আদাবর, পল্টন ও ওয়ারী থানায় এক হাজার ২২৬টি মামলার নথিপত্র পুড়ে যাওয়ার তালিকা করা হয়েছে। বাকি থানাগুলোতে কী পরিমাণে মামলার নথিপত্র পুড়ে গেছে তার তালিকা এখনো তৈরি করা হয়নি।
ভাটারা, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, খিলক্ষেত ও খিলগাঁও থানার ওসিরা জানান, এই থানাগুলোতে লুট হওয়া, পুড়ে যাওয়া কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত মামলার নথিপত্রের হিসাব করা হচ্ছে। ডিএমপি সদর দপ্তরের ক্রিমিনাল ডাটাবেইস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিডিএমএস) থেকেও এসব তথ্য নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আদালত থেকেও এ বিষয়ে সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে।
ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্র জানায়, পুলিশ বাহিনীর কাজ আবারও স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। তবে এখনো ডিউটি অফিসারসহ থানায় দায়িত্বরতরা হাতে লিখে বিভিন্ন অভিযোগ নিচ্ছেন। এখনো ইন্টারনেট সার্ভার ঠিক করা যায়নি বলে কিছু ক্ষেত্রে সেবা দিতে দেরি হচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গত জুলাই মাসে সংঘাত-সহিংসতায় সারা দেশে দেড় শতাধিক অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ঢাকা অঞ্চলে (রাজধানীসহ ঢাকা জেলা) ১০৫টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, যার বেশির ভাগই ঘটেছে পুলিশ বাহিনীর স্থাপনা ঘিরে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, এসব অগ্নিসংযোগের ঘটনার মধ্যে ১৬ জুলাই দুটি, ১৭ জুলাই ১০টি, ১৮ জুলাই ২৫টি, ১৯ জুলাই ৪১টি এবং ২০ জুলাই ২৩টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এরপর ২১ জুলাই ৯টি এবং ২২ জুলাই তিনটি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
রাজধানীর আদাবর থানায় গিয়ে দেখা গেছে, ওই থানার চারটি গাড়ি, ২০টি মোটরসাইকেল, ৩০টি ল্যাপটপ ও কম্পিউটার, পাঁচটি এসি, টিভি, কক্ষের দরজা, ফ্যান, ফ্লোরের কার্পেটসহ অন্যান্য আসবাবে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে। অগ্নিসংযোগের ফলে ভবনের অবকাঠামো ঝলসে গেছে। ওই ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন এখনো বর্তমান থানার ভেতরে-বাইরে।
দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্য জানান, এখন আগের মতো মামলা ও অভিযোগ হচ্ছে না। সংখ্যা কমে গেছে। তবে এই থানায় দায়িত্বরত ১১৬ জন পুলিশ সদস্য চেষ্টা করছেন নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে।
আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে কত সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, যেসব থানার সব কিছু লুট হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের মেসের হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে সব কিছু লুট করা হয়েছে। আর যেগুলো নিতে পারেনি, সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। গাড়ি, অস্ত্রসহ সংশ্লিষ্ট জিনিসগুলো পূরণ করতে একটু সময় তো লাগবেই। তারা জানান, বিভিন্ন মামলার নথিপত্র নতুন করে তৈরি করতে সময় লাগবে। সে ক্ষেত্রে মামলার তদন্তে ব্যাঘাত ঘটবে। আর বিভিন্ন মামলার আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে লিখিতভাবে জানাবেন। প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রে পৃথকভাবে প্রতিবেদন দেওয়া হবে আদালতে।
ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসান বলেন, যেসব মামলার নথিপত্র পুড়ে গেছে সেগুলো ডিএমপির সিডিএমএস থেকে নিয়ে তদন্ত করা হবে। আর যেসব আলামত পুড়ে গেছে বা লুট হয়েছে, সে বিষয়ে আদালতের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিডিএমএসে ডিএমপির ৫০ থানার মামলাগুলোর তথ্য সংরক্ষিত আছে। তবে ডিএমপি সদর দপ্তরে মালখানা না থাকায় সেখানে থানাগুলোর আলামত রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই।
এমটি/ এএটি